একদিন হয়তো ঢাবির নামও বদলাতে হবে— কারণ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটাই তো সংস্কৃত থেকে এসেছে! তখন এই প্রতিষ্ঠানকে হয়তো বলা হবে— ‘উচ্চতর জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিতরণ কারখানা, ঢাকা শাখা’।
Published : 11 Apr 2025, 04:03 PM
পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রাটি দেশবাসীর কাছে এক দৃষ্টিনন্দন ঐতিহ্যের অংশ। রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলার নববর্ষ মানেই চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের সৃষ্টিশীল শিল্প, লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক, আর শত সহস্র মানুষের মিলে-মিশে শুভ, কল্যাণ, সুন্দর আর মানবিক জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে রাজপথে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো যাকে ‘বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই শোভাযাত্রা— যার জন্ম হয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের গর্ভে, আজ হঠাৎ করেই তার নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে। একদল নব্য-জ্ঞানী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন আর ‘মঙ্গল’ নয়, ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে হবে। খেয়াল করুন, শব্দটা বদলেছে— ভাবটা না। ঠিক যেমন আগের দিনে রাজা নাম বদল করে সিংহাসন রক্ষা করতেন, আজকের বুদ্ধিজীবীরা শব্দ বদলে সংস্কৃতির গলা টিপে ধরছেন, যাতে আধুনিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, এবং প্রগতিশীলতা— সব একসাথে হাঁপিয়ে পড়ে, কোমা তে চলে যায়!
ওই পণ্ডিতদের মতে, ‘মঙ্গল’ শব্দটাকে সাবেক শাসকরা কলুষিত করে ফেলেছিল! অতএব, শোভাযাত্রার নাম হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়ে অনেক দিন ধরেই এক শ্রেণির মানুষের আপত্তি ছিল। শুভবোধ, মানবিকতা, সর্বজনীনতা— এই শব্দগুলো যতই চারুকলার রঙে আর কল্পনায় প্রাণ পাক, ‘মঙ্গল’ শব্দটার সমস্যা হলো, ওটা হিন্দুয়ানি, পুরাতন, ওটা ধ্রুপদি, ওটা নাকি অতিরিক্ত পবিত্র! তাই এখন থেকে 'মঙ্গল’ নয়, হবে 'আনন্দ'। অথচ একটু খোঁজ করলেই দেখা যায়, 'আনন্দ' শব্দটাও কিন্তু সেই একই শিকড় থেকে উঠে এসেছে— সংস্কৃত ভাষার ‘আনন্দ’, যার স্থান ভগবদ্গীতা থেকে উপনিষদ পর্যন্ত বিস্তৃত। সেখানে চিরন্তন সুখ মানেই ‘আনন্দ’। একজন মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মিক মিলনে যে পূর্ণতা লাভ করে, সেটাকেই আনন্দ বলা হয়। সেটা কি করে মেনে নিচ্ছেন এই নাম-পরিষ্কারক দল? কী তাদের সূত্র—‘আনন্দ’কে তারা কি নবধর্মীয় রিক্রুট করেছেন নাকি আধুনিক কালিতে নতুন ব্যাখ্যা লিখে দিচ্ছেন? তা হলে কী এই শব্দ বদলের তর্জন-গর্জন আসলে নিরপেক্ষতার নামে একপাক্ষিক অপসারণ?
তবে এদের যুক্তি যুক্তির মতো না, বরং পুরনো আমলের সেই লোকটার মতো, যিনি বাড়ির জানালায় আগুন দেখে বলেছিলেন, “আগুন তো লাল, লাল তো কমিউনিস্ট রং, নিশ্চয়ই এ আগুন রাশিয়ার ষড়যন্ত্র!” এই নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়া যেন বাংলা সংস্কৃতিকে জেলখানার ইউনিফর্ম পরিয়ে দিচ্ছে। শোভাযাত্রার রাজহাঁস, মাছ, মুখোশ, হাতি— সব কিছুই যেখানে প্রতীক হয়ে এসেছে মানুষের মঙ্গলকামনা, কল্যাণ ও শান্তির, সেখানে শব্দটাকেই কেটে ফেলা মানে হলো, মূল ভাবনাটাকেই অপমান করা। যেন কেউ সুন্দর একটি গানের একটা লাইন কেটে দিয়ে বলছে— “এই লাইনটা সমস্যাযুক্ত, কারণ এটা বেশি আবেগপ্রবণ।” অপযুক্তি যে কেমন করে পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে নিজেকে ঢাকে, এই বদল তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।
চারুকলার এই শোভাযাত্রা শুরু থেকে ছিল এক সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ, লাল মাটির মতো জমাট প্রতিবাদ, ঢাকার রাজপথে ধ্বনিত এক সৃষ্টিশীল চিৎকার। তখনকার চারুকলা জানত, মঙ্গল শব্দ মানে শুধু ধর্ম নয়— এটা শুভ, কল্যাণকর, এক জাতীয় মেটাফোর। তাদের চোখে শোভাযাত্রার হাতি, ঘোড়া, মাছ, মুখোশ সব কিছুই ছিল প্রতীক— মানবতাবাদের, অসাম্প্রদায়িকতার, জনগণের মঙ্গলচিন্তার। এখন সেই শোভাযাত্রার ‘মঙ্গল’কে ছেঁটে ফেলে বলা হচ্ছে, এটা নাকি ‘রাজনৈতিক’ হয়ে গেছে।
কে যেন বলেছিল, রাজনীতি আর ধর্ম যদি একসাথে চলতে থাকে, তাহলে ইতিহাস পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে বেসিনে দাঁত মাজতে শুরু করে। এখন মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদল করে যেন ইতিহাসের দাঁতই ফেলে দেওয়া হচ্ছে! আজ যারা এই শোভাযাত্রার নাম বদল করছেন, তারাই একদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতেন— “সংস্কৃতি কারো সম্পত্তি নয়।” আজ তারা বলছেন— “এই শব্দটা কারো ধর্মীয় উৎসের, তাই সরিয়ে দাও।” অথচ এই মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু হয়েছিল গ্রামীণ লোকজ ঐতিহ্যকে সামনের কাতারে রেখে। উদ্যোক্তারা বলেছিল— এই শোভাযাত্রা দল বা মতের নয়, এটা জাতির, এটা বাঙালির।
তাহলে আজ যে এই নাম বদলের মঞ্চে বসে থাকা সিদ্ধান্তগ্রহণকারীরা বলছেন— ‘মঙ্গল’ মানে সংকীর্ণতা, তারা কি এই শোভাযাত্রাকে আবার সংকীর্ণ করারই চেষ্টায় ব্যস্ত? তারা কি আদতে সেই সর্বজনীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, যেটা এই উৎসবের প্রাণ ছিল?
এখন থেকে সবকিছুর নাম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বানাতে হবে? যেমন, আনন্দ বাদ দিয়ে ‘সামাজিক উত্তেজনাবোধ’? ফুলকে বলা হবে ‘পুষ্পীয় জৈব প্রলেপ’? আর নববর্ষ হবে ‘বাংলা সময়চক্রের অশ্লীল আনুষ্ঠানিকতা’? কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রার বদলে হয়তো বলা হবে ‘দেখে যাও, আমরা এখন কতটাই না পরিবর্তনশীল বাংলাদেশ শোভাযাত্রা’?
ইউনেস্কো যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্ব ঐতিহ্য বলেছিল, সেটা এখন কী হবে? তারা কি নতুন নাম জানলে তালিকা থেকে কেটে দেবে? কি লিখবে UNESCO? “বাংলাদেশ has a very important intangible heritage called... umm... well, formerly known as Mangal... now happy-fun-walky-new-year-thing.”
তবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় আশ্বস্ত করতে পারবেন, এই নাম বদলের পেছনে আছে গভীর গবেষণা, অন্তত দুইটা পিডিএফ আর তিনটা পাওয়ারপয়েন্ট। হয়তো একেকটা স্লাইডে লেখা, ‘মঙ্গল মানে মঙ্গলগ্রহ। আমরা তো জানিই, গ্রহপূজা হিন্দুয়ানি।’ আরেকটা স্লাইডে হয়তো বলেছে, ‘মঙ্গল = Planet। Planet = Astrology। Astrology = ধর্ম। ধর্ম = সমস্যা। অতএব, মঙ্গল = সমস্যা।’ বিশ্লেষণ এমনই, যাতে যুক্তি আত্মহত্যা করে। তখন হয়তো বলা হবে— ‘ভালো থেকো’ না বলে বলুন, ‘সামাজিকভাবে নিরপেক্ষ সহনশীল অবস্থায় অবস্থান করুন।’
এই প্রবণতা চলতে থাকলে সামনে কী হবে? ‘পয়লা বৈশাখ’ও তো ‘ফারসি’— পয়লা মানে প্রথম, ফারসি শব্দ। বৈশাখ আবার বৈদিক পঞ্জিকার মাস। তাহলে নববর্ষের নামই কি আবার বদলাতে হবে? বলা হবে— ‘বাংলা সময়-চক্রের সামাজিক পুনর্নবীকরণ উৎসব’? নাকি ‘প্রথম বাংলাঋতু-সম্বন্ধীয় নাগরিক ভোরঘুম উৎখাত কর্মসূচি’?
যদি এই ধারা চলতেই থাকে, তবে আগামী বছর হয়তো ঢাবি চারুকলা থেকে বের হবে ‘নামমাত্র শোভাযাত্রা’— যেখানে শিল্প থাকবে, লোকজ রং থাকবে, কিন্তু আত্মা থাকবে না। থাকবে না সেই বার্তা, যা বলে— ‘সকলের মঙ্গল হোক’। বরং থাকবে কেবল এক ধরনের প্রশাসনিক সতর্কতা, এক ধরনের বর্ণহীন, বিবর্ণ, রংচটা উৎসব।
এখন শুধু অপেক্ষা— কবে ‘আনন্দ’ শব্দটা নিয়েও কেউ আপত্তি তুলবে। কারণ সেটাও তো বৈদিকদের ধর্মীয় গ্রন্থে ব্যবহৃত শব্দ! তখন হয়তো ঢাবি আবার সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নেবে— নতুন নাম হবে ‘ঋতুভিত্তিক নাগরিক সঙ্গমযাত্রা’।
‘মঙ্গল’ বাদ দিয়ে কেউ আনন্দ বাড়ায় না। যাদের চোখে সংস্কৃতি মানে শুধুই ধর্মের প্রতিফলন, তারা শিল্প বোঝে না, ইতিহাস বোঝে না, এবং মর্মান্তিকভাবে— বাংলাদেশের আত্মার একটা বড় অংশ বোঝে না। যারা একদিন শোভাযাত্রার প্রতীক দিয়ে স্বৈরাচারকে বিদ্রূপ করেছিল, আজ তারা হয়তো আয়নায় নিজেদের দিকে তাকিয়ে বলতে পারছে না— আমরাও একধরনের স্বৈরতন্ত্রকেই আঁকছি, শুধু রংটা একটু বদলে।
একটা কথা শেষমেশ বলতেই হয়— বাংলা নববর্ষের উৎসব, চারুকলার এই শোভাযাত্রা, কেবল শিল্প নয়, কেবল সংস্কৃতি নয়— এটা একটা প্রতিরোধ, একটা ঐতিহ্য, একটা স্বাধীনতার রঙিন ভাষ্য। এর ভেতর যে 'মঙ্গল' লুকানো, সেটা ধর্মীয় নয়, মানবিক। আর যদি সেটাই না বোঝা যায়, তাহলে একদিন হয়তো ঢাবির নামও বদলাতে হবে—কারণ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটাই তো সংস্কৃত থেকে এসেছে! তখন এই প্রতিষ্ঠানকে হয়তো বলা হবে— ‘উচ্চতর জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিতরণ কারখানা, ঢাকা শাখা’।
তাই, আসুন আমরা আনন্দ করি! কারণ, ‘আনন্দ’ তো এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু কে জানে, কালকেই হয়তো কেউ দাবি করে বসবেন— ‘আনন্দ’ শব্দটিও খুবই সন্দেহজনক! তখন হয়তো নাম হবে— ‘বর্ষবরণ উল্লাস পদযাত্রা’। আর যদি সেখানেও সমস্যা থাকে, তাহলে শেষ বিকল্পটি খোলা আছে: ‘বর্ষবরণ শব্দহীন নীরবতা’।
কারণ, এই যুগে কথা বলার চেয়ে চুপ থাকাটাই বেশি ‘মঙ্গলকর’!
আরও পড়ুন