আমি সেই পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, যে-চাঁদ হলো একখানা রুপোর চামচের মতো যেটাকে যতোই ঘষামাজা করা হোক চকচকে করে তোলা যাবে না।
Published : 10 Apr 2025, 12:03 PM
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হান কাঙের মোট আটটি উপন্যাসের মধ্যে এটি পঞ্চম, তবে ইংরেজিতে প্রকাশের হিশেবে চতুর্থ। ২০১১ সালে কোরীয় ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পরে ২০২৩ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রথমবার হান কাঙের একাকী ইংরেজি অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ তরুণ এক কোরীয় অনুবাদক এমিলি ইয়ে ওয়ানের সাথে যুগলবন্দি রচনা করেছেন, যা, আশা করা যায়, তাঁর অনুবাদের মর্মগ্রাহিতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, অনুবাদে মূল পাঠের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা যেন আরও নিপুণ অক্ষরে ফুটে ওঠে তা নিশ্চিত করেছে, এবং অনুবাদকের স্বভাবসুলভ বিচ্যুতিপ্রবণতা থেকে অনূদিত পাঠটিকে আরও সজাগ ও-সুযোগ্যভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। বাংলা অনুবাদটি যেহেতু এই ইংরেজি অনুবাদের মারফত মূল কোরীয় উপন্যাসটির রূপ-রস- ও গন্ধ বাংলাভাষী পাঠকের সংবেদনশক্তির নিকট নিবেদন করছে তাই এ-তথ্যটুকু উৎসাহব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। আজ প্রকাশিত হলো উপন্যাসটির তাৃতীয় কিস্তি।
রাতটা বিপর্যস্ত।
আধ ব্লক দূরের দ্রুতগমন মহাসড়ক থেকে আসা কতোগুলো ইঞ্জিনের গর্জন বরফের ওপর দিয়ে চলা অজস্র স্কেট-ফলার মতো তার কানের পর্দা চিরে চিরে দেয়।
সড়ক-বাতির দ্যুতিতে আলোকিত লিলি ম্যাগনোলিয়া তার কালশিটে-পড়া পাপড়িগুলোকে হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয়। সে হেঁটে যায় ডালপালা ভারাক্রান্ত করে তোলা থোকা-থোকা ইন্দ্রিয়সুখকর ফুলের পাশ দিয়ে আর থ্যাঁতলানো পাপড়ির আগাম মাধুরীতে মৌ মৌ করা বসন্ত রাতের বাতাসের মধ্য দিয়ে। গাল দু’টো তার শুকনো সেটা জানা থাকা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই সে নিজের দু’হাত চেহারায় তোলে।
প্রচারপত্র ও কর-নোটিশে ঠাসা ডাকবাক্সটা পেরিয়ে সে নিচতলার সদর দরজার তালায় চাবি গলায়। লিফটের শীতল চেকনাইয়ের পাশে দরজাটা এক জগদ্দল ও টেকসই সত্তা।
ফ্ল্যাট ভরতি হয়ে আছে বাচ্চাটির রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নে, এমনসব জিনিশে যা সরিয়ে রাখতে সে নারাজ ছিলো। এ-ভরসায় যে, আদালতের আরেকটি শুনানিতেই ওকে ফিরে পাওয়া যাবে। পুরনো মখমলের সোফার পাশে যে নিচু বইয়ের তাকটা রয়েছে, সেটা ঠাসাঠাসি হয়ে আছে কতোকগুলো ছবির বইয়ে যেগুলো ওর দুই বছর বয়সে তারা দু’জনে মিলে পড়া শুরু করেছিলো। ওদিকে জন্তু-জানোয়ারের স্টিকার শোভিত খাঁজ-তোলা পিজবোর্ডের বাক্সে বাক্সে রাখা আছে হরেক রকমের লেগোজাতীয় ইট।
অনেক বছর আগে নিচতলার এই থাকার জায়গাটিকে সে পছন্দ করেছিলো যাতে তার ছেলে ইচ্ছেমতো খেলাধুলা করতে পারে। কিন্তু থপথপিয়ে হাঁটার বা দৌড়ে বেড়ানোর কোনো বাসনা ওর মধ্যে দেখা যায়নি। বৈঠকখানায় দড়িলাফ খেললে কোনো অসুবিধা নেই, সে এ-কথা বললে ও জিগেস করেছিলো, “কিন্তু পোকা আর শামুকদের ওই আওয়াজে অসুবিধা হবে না?”
বয়সের তুলনায় ও ছিলো ছোটোখাটো, আর পলকা গড়নের। বই পড়তে পড়তে কোনো ভয়ের দৃশ্য পেলে ওর তাপমাত্রা চড়ে যেতো আটত্রিশ ডিগ্রির ওপরে, আর কোনো কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলে বমি করতো বা ডায়রিয়ায় পড়তো। ও যেহেতু ছিলো একইসাথে প্রথম-জন্মানো পুত্রের ঘরের জ্যেষ্ঠ নাতি ও বাবার দিককার একমাত্র ছেলে শিশু, যেহেতু ও তখন আর খুব বেশি ছোটো ছিলো না, যেহেতু তার প্রাক্তন স্বামী অবিচলভাবে দাবি করেছিলো যে, সে অতি দুর্ভাবনা-বাতিকে ভোগে আর ছেলের ওপরে সেটার কুপ্রভাব পড়ছে – কিশোরী বয়সে সে যে মানসিক চিকিৎসা নিয়েছিলো তার নথিপত্র প্রমাণ হিশেবে পেশ করা হয়েছিলো – যেহেতু তার রোজগার স্বামীর তুলনায় – সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে সেই লোক ব্যাংকের প্রধান শাখায় পৌঁছেছিলো – একইসঙ্গে যৎসামান্য ও অনিয়মিত, কাজেই শুনানিতে শেষমেশ সর্বতো পরাজয় ঘটেছিলো। এখন যেহেতু সেই যৎসামান্য রোজগারও আর হাতে নেই, তাই আরেকটি মামলা পাকিয়ে তোলা অসম্ভব ছিলো।
****
জুতা না খুলেই তার সদর দরজার ভেতরকার উঁচু ধাপে সে বসে পড়ে। পাশে নামিয়ে রাখে নিজের ব্যাগটা, যাতে আছে তার মোটা মোটা গ্রিক পাঠ্যপুস্তক ও অভিধান, তার অনুশীলনের খাতা আর একটি চ্যাপটা পেন্সিল বাক্স। সে চোখ বুজে হলুদ সেন্সর আলোটা বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। অন্ধকার হয়ে গেলে সে চোখ খোলে। আঁধারে গুড়ি মেরে থাকা কালো আসবাব, কালো পর্দা, নিশ্চলতায় ডুবে থাকা কালো বারান্দার দিকে সে তাকায়। অতি ধীরে, সে ঠোঁটজোড়া খোলে, তারপর ঠোঁটে ঠোঁট চাপে।
তার হৃদপিণ্ডে বসানো শীতল বিস্ফোরকদ্রব্যের জ্বলন্ত সলতে ফুরিয়ে গেছে। যেসব শিরায় আর রক্ত প্রবাহিত হয় না তাদের মতোই খালি হয়ে আছে তার মুখের ভেতরটা, লিফটের যে-কূপে লিফট চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এ সেই লিফট-কূপের মতোই খালি। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সে তার চিরকালের শুকনো গাল মোছে।
একসময় তার অশ্রু যে-পথ বেয়ে নামতো শুধু যদি তার একটি মানচিত্র সে করে রাখতো।
একসময় যে-পথ ধরে শব্দরা প্রবাহিত হতো শুধু যদি একটি সুঁই দিয়ে সে-পথের ওপরে সে খুদে খুদে ফুটো, অথবা স্রেফ রক্তের ছিটেফোঁটাই এঁকে রাখতো।
কিন্তু, তার জিভ ও কণ্ঠের চাইতে গহিনতর কোনো স্থান থেকে সে বিড়বিড় করে বলে, সে-পথ বড়ো ভয়ঙ্কর।
৩
আমার বয়স যখন পনেরো তখন গ্রীষ্মের শুরু।
এক রবিবার রাত, আর পূর্ণিমার চাঁদ একটু পরে-পরেই মেঘের ধূসর, অসমান চাদরে ক্ষণিকের জন্যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলো। আমি সেই পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, যে-চাঁদ হলো একখানা রুপোর চামচের মতো যেটাকে যতোই ঘষামাজা করা হোক চকচকে করে তোলা যাবে না। এমন একটি মুহূর্ত এলো যখন রহস্যময়, অস্বস্তিকর সংকেতের মতো চাঁদের যে-জ্যোতির্বলয় সেটা মেঘে মেঘে ছড়িয়ে দিলো এক নীলাভ লাল বৃত্ত।
সুয়ুরির বাড়ি থেকে ‘এপ্রিল ১৯ বিপ্লব সমাধিক্ষেত্র’-এর খানিকটা দূরের যে-চৌরাস্তা সেটুকু পর্যন্ত বড়জোর তিনটে বাস স্টপ পড়তো, কিন্তু আমি এতো ধীরগতিতে হাঁটলাম যে, আমার বেজায় দীর্ঘ সময় লাগলো। যতোক্ষণে আমি মোড়ের বইয়ের দোকানটায় পৌঁছোলাম ততোক্ষণে টিভি-রেডিয়োর দোকানের প্রদর্শ-জানালার টেলিভিশনগুলোর পর্দায় নয়টার সংবাদের শুরুটা দেখানো হচ্ছিলো। আমি যখন বইয়ের দোকানটায় ঢুকলাম, তখন কোঁচকানো ধূসর শার্টের ওপরে চওড়া, চ্যাপটা পোশাক-বাঁধুনি পরা মধ্যবয়সি মালিক লোকটি মাত্রই দোকান বন্ধ করার আয়োজন করছিলেন। আমি তাঁর কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে কেনার মতো কিছু চোখে পড়ে কিনা তা দেখতে তড়িঘড়ি বইয়ের তাকগুলোয় নজর বোলালাম। তখন যে-একটি বই আমি তুলে নিয়েছিলাম ঠিক সেটিই এখন আমি হাতে ধরে আছি, বৌদ্ধধর্মের ওপরে বোর্হেসের গণবক্তৃতামালার একটি পকেট-বই আকারের অনুবাদ।
বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক আমার সেসময়কার যা যা ধারণা তার সবটাই জোটানো হয়েছিলো দু’সপ্তাহ আগে আমার মা ও ছোট বোনের সাথে বুদ্ধের যে-জন্মোৎসবে আমি যোগ দিয়েছিলাম তার স্মৃতি থেকে। সেই দিন ও সেই রাতে আমি এমন এক জমকালো অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলাম যেটিকে, সব দিক বিবেচনা করলে, বলা যেতে পারে তখন-অব্দি আমার অল্পকালের জীবনের সবচেয়ে চোখ-ধাঁধানো অনুষ্ঠান। মন্দিরের প্রধান সমাবেশ-কক্ষের সামনের আঙিনায় রৌ্দ্রে দুলছিলো রক্তিম নীল কোরীয় কাগজ দিয়ে একটা-একটা করে তৈরি করা পাপড়িতে সজ্জিত সব লণ্ঠন। উৎসব উপলক্ষ্যে মন্দিরের পক্ষ থেকে বিতরণ করা হয়েছিলো অনেকটা পানসে স্বাদের নুডলসের ভোজ, যেটা অর্ঘ্য দানের জায়গার সামনে, জেলকোভা গাছের ছায়ায় খেয়ে নিয়ে আমরা গা এলিয়ে বসে আঁধার নামার অপেক্ষায় থেকেছিলাম। অবশেষে যখন কাগজের লণ্ঠনগুলো জ্বালানো হয়েছিলো, আমি হয়ে পড়েছিলাম আনন্দে আত্মহারা, রীতিমতো তাক লেগে গিয়েছিলো – কালিগোলা আঁধারে সারে সারে দুলছে শত শত হাঞ্জি লণ্ঠনের লাল-শাদা, ভেতর থেকে মোমবাতির উষ্ণ আলো প্রশান্তির সাথে চুঁইয়ে পড়ছে বাইরে। “আমাদের এখন বাড়ি যেতে হবে,” আমার মা তাগাদা দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি ওইখানেই স্থাণু হয়ে রয়েছিলাম।
রবিবার সকালে আমার মা যখন জানান দিলেন যে, দুই মাসের ভেতরেই আমাদের পরিবারকে কোরিয়া ছেড়ে যেতে হবে, তখন এমন কেন হলো যে, ওই লণ্ঠনগুলোর ছবিই এতো স্পষ্টভাবে আমার মনে ভেসে উঠলো? ওই বাতিগুলো আমার মনে যে-ছাপই ফেলে থাকুক না কেন সেটা যে ঠিক ধর্মীয় সম্ভ্রম জাতীয় কিছু নয় সে-হুঁশ ভাসাভাসাভাবে থাকলেও, সেই রাতে আমি যখন মায়ের দরাজ হাতে দেওয়া নগদ অর্থ নিয়ে জার্মান ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক ও সংলাপের টেপ কিনতে গিয়েছিলাম, তখন খপ করে লোভীর মতো গিয়ে ধরেছিলাম সুত্তনিপাত, ধর্মপদ, হোয়াইওম সূত্র প্রবচনসংগ্রহ, ইয়ল ব্যাংইয়ং প্রবচনসংগ্রহ, যেগুলোর ছিলো ইষ্টক-নকশাওয়ালা প্রচ্ছদ আর প্রকাশিত হয়েছিলো ‘হাইনামসা’ প্রকাশনী থেকে। আমি নিশ্চয়ই মনে মনে এক ধরনের ধোঁয়াটে ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আশা পুষেছিলাম যে, পৃথিবীর অপর মাথায় যে-জার্মানি সেখানে এসমস্ত বই নিয়ে গেলে আমাদের পরিবারের বরাত নিরাপদ থাকবে।
বোর্হেসের এই পাতলা বইটি ওই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলো আমার এ-প্রয়োগবাস্তবতামুখী প্রত্যাশার কারণে যে, প্রতীচীবাসীর হাতে লেখা হয়েছে মানে এটি অতি প্রাথমিক একখানা পরিচিতিমূলক পুস্তিকার কাজ সারবে। সবুজ প্রচ্ছদের ওপরের অংশে শাদা-কালোয় পুনর্মুদ্রিত তাঁর সেই আধ-বোজা চোখ নিয়ে বুকের সামনে প্রার্থনা বা অনুতাপের ভঙ্গিমায় একত্রে দুই হাত মুঠো করে রাখা ছবিটির দিকে সে-সময় আমি তেমন মনোযোগ দেইনি।
জার্মানিতে কাটানো সতেরোটি বছর আমি ওসব বই ধীরে-সুস্থে পড়েছি বার-বার করে। কোনো কোনো রাতে, কেবল হাঙ্গুলের চিরচেনা অবয়বে চোখ বোলানোর বাসনাতেই আমি একটি পৃষ্ঠাও না-উলটে একখানা বই খুলে বসে থাকতাম বেশ অনেকক্ষণ। যেই বইটাই খুলতাম, সুয়ুরির সেই প্রথম দিককার গ্রীষ্ম-রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া আমি আবার টের পেতাম। ওই বইগুলোর সৌজন্যেই আমি সেই চাঁদখানি ভুলে না গিয়ে থাকতে পেরেছিলাম যেই চাঁদ একটি মলিন রুপোর চামচের মতো হয়ে ছিলো, ভুলে যাইনি এর নীলাভ লাল জ্যোতির্বলয় যেটিকে দেখে মনে হয়েছিলো কোনো-এক বিপর্যয়কর ঘটনার একটি রহস্যময় পূর্বাভাস।
আর এমনি করেই যে-বইটি শেষমেশ হয়ে উঠেছিলো আমার প্রিয় সেটি ছিলো ‘হাইনামসা’ প্রকাশিত হোয়াইওম সূত্র প্রবচনসংগ্রহ ; এরপর যে-কয়টি বই আমি পড়েছিলাম তার কোনোটিতেই আর কখনোই আমি এমন চোখ-ঝলসানো চিত্রকল্প মারফত নির্মিত কোনো চিন্তা-ব্যবস্থার দেখা পাইনি। ওদিকে বোর্হেসের বইটি আমার প্রত্যাশামাফিক সহজ ও শাদামাটা হওয়ায় তুলনামূলক তাড়াতাড়ি সেটি উলটে-পালটে রেখে দিয়েছিলাম একপাশে। কিছুকাল বাদে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমাকে জার্মান ভাষায় তাঁর কল্পসাহিত্য আর একটি সমালোচনামূলক জীবনী পড়তে হয়েছিলো; সেই সময়েই আমি ফের বইখানা খুলে আনকোরা এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেটি পড়েছিলাম।
আজ সকালে, এই পাতলা সবুজ বইটিকে আবার মনে পড়ায়, গুদামঘরে রাখা আমার সুটকেশ থেকে সেটি নিয়ে এলাম। কয়েক পৃষ্ঠা উলটে, আমি অপরিশীলিত হস্তলিপিতে লেখা একটি টীকা আবিষ্কার করলাম। বোর্হেসের একটি বাক্য, জগৎ একটি বিভ্রম, আর বেঁচে থাকা হচ্ছে স্বপ্নে থাকা, -এর ঠিক নিচে যাচ্ছেতাই হাতের লেখায় টীকাটি ছিলো এমন : সেই স্বপ্ন কী করে এতো জীবন্ত হয়? কী করে বয়ে চলে রক্ত আর ঝরঝরিয়ে নেমে আসে উষ্ণ অশ্রু?
তার নিচে, জীবন লেখা আছে মনে হলো, জার্মান ভাষায় লেখা জীবন, তারপর একটা মোটা আনুভূমিক রেখা টেনে কেটে দেওয়া।
হাতের লেখা স্পষ্টতই আমার, অথচ এটি লেখার কোনো স্মৃতি আমার ছিলো না। আমি শুধু জানতাম যে, লেখার কালিটা অবিকল সেই গাঢ় নীল কালি যেটা জার্মান ছাত্ররা কিছু টোকার জন্যে ব্যবহার করে।
ডেস্কের দেরাজ খুলে আমার পেন্সিল রাখার পুরনো ধূসর চামড়ার খাপটার জন্যে ভেতরটা আমি তন্নতন্ন করলাম। খাপের ভেতরে ছিলো একটি ঝরনা কলম, ঠিক যেমনটা আমার মনে পড়ছিলো। প্রথম যখন জার্মানিতে চলে আসি তখন হুবহু এই কলমটাই ব্যবহার করেছিলাম; বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে কলমটা অবশেষে সরিয়ে রাখার আগে এর নিবটা আমি বদলেছিলাম অসংখ্যবার। আমি খুলে ফেললাম কলমের খাপ, দুয়েকটা আঁচড় বাদ দিলে যেটা অক্ষতই ছিলো, তারপর নিবের ওপরে জমে শক্ত হয়ে থাকা শুকনো কালি ধুয়ে ফেলার জন্যে ঝরনা কলমটিকে নিয়ে গেলাম গোসলখানায়। পরিষ্কার পানি দিয়ে সিংক ভরে নিবটাকে ডোবালাম। গাঢ় নীল কালি সরু, থিরথিরে ফিতের মতো পানির ভেতর দিয়ে অনর্গল এগোতে লাগলো।
চলবে