ছোট্ট মেয়েটির দু চোখ ভরা স্বপ্ন, তার পুতুলের বাক্স, ও রেলগাড়ি দেখার ইচ্ছা—এসব যেন আমাকে জানায় বেঁচে থাকা কি সুন্দর!
Published : 08 Mar 2025, 05:40 PM
সত্যবতী:
বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ নারী চরিত্রদের কথা বলতে গেলে সবার শুরুতে বলা যায়, প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালী কথাসাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর অমর দুই সৃষ্টি—সত্যবতী, সুবর্ণলতা। আশাপূর্ণা দেবীর রচনার মূল উপজীব্য ছিল বিংশ শতাব্দীর সাধারণ মেয়েদের জীবন ও তাদের মনস্তত্ত্ব। তাঁর গভীর অন্তদৃষ্টি, পর্যবেক্ষণশক্তি, ও সুনিপুণ সৃজনশীলতার কারণে আমরা পেয়েছি সত্য ও সুবর্ণকে। নারীর অধিকার বিষয়টা ক্ষতি করলো না ভালো করলো এসব নিয়ে আমাদের সমাজে যখন বাক-বিতন্ডার কোনো কমতি নেই তখন আমি পড়ি আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’। আমি জানি সত্যবতীকে। এবং আমি বুঝি যে আমি কি করতে চাই, কিভাবে বাঁচতে চাই—এটা যতক্ষণ আমি ঠিক করি ততক্ষণই সেটা আমার অধিকারের আওতায় পড়ে কারণ আমার হয়ে যখন আমার জীবনব্যবস্থা তুমি ঠিক করে দাও তখন সেটা আর আমার থাকেনা। সত্যবতী আমায় নিজেকে জানতে শেখায়, বুঝতে শেখায়, সে আমাকে বলে শক্ত হতে, বিদ্যা লাভ করতে, নিজের দক্ষতা বাড়াতে, মনটাকে রাখতে বলে খোলা আকাশের মতো। জীবনকে দেখতে বলে বড় ক্যানভাসে। সত্যবতী আমাকে স্বপ্ন দেখতে শেখায় এবং তার কারণেই আমি প্রমাণ পাই এ কথাটির যে, ‘’মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।‘’
সুবর্ণলতা:
‘সুবর্ণলতা’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সুবর্ণ যে কিনা সত্যবতীরই মেয়ে, সেও কি আমায় কম কিছু শেখায়? ঠাকুরমার কারণে অল্পবয়সে সুবর্ণের বিয়ে হয়ে যায়। ছোট থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক বাড়ির বউ হিসেবেই তার এই জীবনআখ্যান। কিন্তু সেই পরিচয়ের মধ্যেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল আরেকটি পরিচয়—সবচেয়ে বড় পরিচয়—সে সুবর্ণ, এতো সবের পরেও সে সুবর্ণ যার শখ কবিতা পড়ার। যে বইপ্রেমী, যে প্রতিবাদমুখর, যার একটা ঝুলবারান্দার শখ। অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে এসে যে বাড়িতে সুবর্ণ ছিল একটা লতাগাছের মতো, একদিন সেই বাড়িতেই সুবর্ণ বিশাল বটবৃক্ষ হয়ে ডাল পালা ছড়ায়, তার ছায়ায় থাকে বাকিরা যদিও মেয়ে মানুষ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কোনো কমতি তখনো ছিলো না। কিন্তু তাও সে বদল এনেছে। মা সত্যবতীর মতো ততোটা শক্তি হয়তো তাঁর ছিল না কিন্তু নীরবে নিভৃতে নারীমুক্তির আকাঙ্খাকেই সে মনে লালন করেছে। ঝুলবারান্দার শখ থেকে নিজের একটা ঘর, নিজে পড়াশোনা না করতে পারা থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এবং আমৃত্যু নিজের মা সত্যবতীকে মনে-প্রাণে ধারণ করে লড়াই করে যাওয়া—অধিকারের লড়াই—মেয়েমানুষের জীবনে একটুখানি শান্তি, নিজের একটা ঘর, একটুখানি কবিতা, একটা ঝুলবারান্দা, ও মতপ্রকাশের অধিকার—বাঁচার অধিকার।
দুর্গা:
বাংলাসাহিত্যে নারী চরিত্রদের কথা বলতে গেলে দুর্গার কথা বলতেই হয়। এ যেন এক অমোঘ নিয়ম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গা। নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায় ও সর্বজয়ার মেয়ে ও অপুর বোন দুর্গা। বিভিন্ন বিষয়ের চিরায়ত মর্যাদায় ‘পথের পাঁচালী’ গ্রন্থটি মহিমান্বিত এবং সেসব বিষয়ের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুর্গার চরিত্রটি। বইটি পড়তে পড়তে দুর্গাকে খুব আপন মনে হয়, অতীতকালের এই বালিকার সবুজে ঘেরা জীবনযাপন দেখে মন ভালো হয়, তার সরলতা আমাকে মুগ্ধ করে, অল্পেই খুশি হয়ে যাওয়া এই মেয়েটির জন্য মন ভার হয়। উপন্যাসে দুর্গার বয়স হিসেব করলে সে আমার থেকে খুব ছোট। অথচ ছোট্ট এই মেয়েটি আমার জন্য যেন অনুপ্রেরণার এক ভান্ডার। ইন্দির ঠাকরুনের প্রতি দুর্গার মায়াময় চাহুনি আমাকে শেখায় মানুষ কেমন হয়, মানবতা কেমন হয়! বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে মাঠ-ঘাট, গাছতলা থেকে এটা সেটা কুড়িয়ে বাড়ি ফিরে দুর্গা যখন সেসব অপু ও সর্বজয়াকে দেখায় তখন আমার মনে হয় দুর্গা যেন পৃথিবী জয় করে এলো। দুর্গার হাসি যেন আমার কানে বাজে। ছোট্ট মেয়েটির দু চোখ ভরা স্বপ্ন, তার পুতুলের বাক্স, ও রেলগাড়ি দেখার ইচ্ছা—এসব যেন আমাকে জানায় বেঁচে থাকা কি সুন্দর! পিসিমার মুখে ছেলেবেলায় শেখা ছড়াটি দুর্গা যখন আবৃত্তি করে তখন যেন আমিও মনে মনে বলি—
‘’হলুদ বনে বনে—
নাক-ছাবিটি হারিয়ে গেলে সুখ নেইকো মনে—‘’
আবার সেই দুর্গাই যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে ভাইয়ের কানে কানে বলে, ‘’আমায় একদিন তুই রেলগাড়ি দেখাবি?’’ এবং যখন সেই রেলগাড়ি জীবনে আর কোনোদিন তার দেখা হয়না—তখন আমার মনে হয় দুর্গা তো একা নয়, এমন তো কতশত দুর্গা আশেপাশে আছে যাদের জীবনটাকে বুঝে ওঠার আগেই সে জীবনের প্রদীপ নিভে যায় কিংবা কেউ অনেকটা সময় নিয়ে এ পৃথিবীতে থাকে বৈকি তবে এ জীবনের কিছুই তার দেখা বা পাওয়া হয় না—এমনকি সামান্য রেলগাড়ি দেখাটুকুও হয়না, তপ্ত রোদে কাশবন থেকেই ফিরে আসতে হয়।
‘“আকাশের নীল আস্তরণ ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে অনন্তের হাতছানি আসে—পৃথিবীর বুক থেকে ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া গিয়া অনন্ত নীলিমার মধ্যে ডুবিয়া নিজেদের হারাইয়া ফেলে—পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূরপারে কোন পথহীন পথে—দুর্গার অশান্ত, চঞ্চল প্রাণের বেলায় জীবনের সেই সর্বাপেক্ষা বড় অজানার ডাক আসিয়া পৌঁছিয়াছে।”
এই ক’টা লাইন, দুর্গার স্বল্পদৈর্ঘের জীবন, সে জীবনের প্রতি তার ভালোবাসা, তার সরলতা, অশান্ত-চঞ্চল মন, ইন্দির ঠাকরুনের জন্য বুকভরা মায়া, ভাইয়ের জন্য অসীম ভালোবাসা—এসব একসাথে আমার সামনে এক অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য তুলে ধরে। আমাকে বলে জীবনকে ভালোবাসতে, নিজের সরলতাকে হারিয়ে না যেতে, এবং বলে, মানুষ হও, মনে মায়া রাখো, ভালোবাসো আশপাশের প্রকৃতি, প্রিয়জন ও জগতসংসারকে।
জয়গুন:
আবু-ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’ উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান চরিত্র জয়গুন। এ উপন্যাসে আমরা জয়গুনকে দেখি এক শক্তিশালী রূপে। কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুরুষতন্ত্রের শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট গ্রামীণ সমাজ ও বিভিন্ন প্রথাকে উপেক্ষা করে জয়গুন তার জীবন-সংগ্রাম চালিয়ে যায়। জয়গুন যেন এ যুগের নারীদের জন্য আত্নোন্নয়নের এক প্রতীক। শত ঝড়-ঝঞ্জা, সূর্য-দীঘল বাড়িকে নিয়ে রটে থাকা কুসংস্কার, ভয়-ভীতি, ও গ্রামের মোড়লের মতবিরোধ উপেক্ষা করে একবেলা খাবার জোটাতে বাইরে গিয়ে কাজ করে জয়গুন। যুদ্ধ করে টিকে থাকে পুরুষতান্ত্রিক এক সমাজে। নিজের সিদ্ধান্তে থাকে অটল। মনকে রাখে শক্ত। ধর্মের চেয়ে নিজের স্বার্থকে যারা বড় করে দেখে, ধর্মের নাম করে নারীদের গৃহবন্দী যারা করতে চায়, তাদেরকে কঠোর জবাব দিয়ে জয়গুন নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকে। কারণ সে জানে পর্দার কথা বলা এসব মানুষজন কখনোই তার দুয়ারে এক থালা ভাত নিয়ে আসবে না। তাই নিজের ও সন্তানদের জন্য তাকেই রুখে দাড়াতে হবে সকল প্রতিকূলতার বিরদ্ধে।
পুষ্প ও নিশাত:
জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘প্রিয়তমেষু’র প্রধান দুই নারী চরিত্র হলো নিশাত ও পুষ্প। নীল রঙা প্রচ্ছদের মাত্র সাতাশি পৃষ্ঠার একটা বই ‘প্রিয়তমেষু’। খুব ছোট্ট একটা বই। কিন্তু এ বইটা যেন বাংলাদেশের সমাজের একটা প্রতিচ্ছবি! মেয়েদের জীবনের এক প্রতিচ্ছবি! ‘প্রিয়তমেষু’ নিশাত ও পুষ্প নামের দুই মেয়ের গল্প। এটা বাংলাদেশের হাজার হাজার মেয়ের গল্প। এটা বাংলাদেশের সেইসব মেয়েদের গল্প যারা জীবনের কোনো এক পর্যায়ে যৌন হয়রানির স্বীকার হয়েছে। এ বইয়ের মাধ্যমে লেখক আমাদের দেখিয়েছেন যে এই সমাজ যৌন হয়রানির স্বীকার হওয়া বা ধর্ষিত হওয়া মেয়েটিকেই দোষী সাব্যস্ত করতে উঠে পড়ে লাগে। ধর্ষক কিংবা হয়রানকারির দিকে যদি একটা আঙ্গুল ওঠে তাহলে বাংলাদেশের সমাজ বাকি চার আঙ্গুল তাক করে রাখে ভিক্টিম মেয়েটির দিকে। যেখানে আসলে মেয়েটির দিকে কোনো আঙ্গুল তাক করার কথাই না কারণ যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের একমাত্র কারণ ধর্ষক বা হয়রানিকারি নিজেই। এখানে আর কোনো ব্যাখা বা কিন্তুর কোনো প্রয়োজন নেই।
এ উপন্যাসে নিশাত ও পুষ্পের মাধ্যমে লেখক একজন ধর্ষিতা ও যৌন হয়রানির স্বীকার হওয়া মেয়ের মনের অবস্থা এবং বছরের পর বছর সে কিভাবে এই ট্রমা বয়ে বেড়ায় তা তুলে ধরেন। সেইসাথে আমরা দেখি দুইজন নারীকে যাদের মনের শক্তি অসাধারণ। পুষ্প ও নিশাত প্রতিবেশি। নিজের স্বামীর বন্ধু মিজানের দ্বারা পুষ্প ধর্ষিত হয়, যদিও মিজানের ভাষ্যমতে এটা তেমন কোনো বিষয় না। সমাজের ভাবনাও ঠিক তাই কারণ ধর্ষকের কিছুই হয়না, মেয়েটির ই সম্মানহানি। বহু ঝড়-ঝঞ্জার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, বহু প্রশ্নের সম্মুক্ষিন হতে হবে, আদালতে রীতিমত চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে—এ সব জেনেও পুষ্প আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সে বিচার চায়। আর এই পুরো সময়টা নিশাত ঢাল হয়ে পুষ্পের পাশে থাকে। পুষ্পের স্বামী চায় এই কেস আদালতে না উঠুক। নিশাতের স্বামী ও পুরো পরিবার চায় নিশাত এ ঝামেলায় না পড়ুক তবুও এই দুই নারী লড়ে যায়, একদম শেষ পর্যন্ত। বিচারের শেষ পর্যায়ে যখন দেখা যায় পুষ্পরা কেস জিতে যায় তখন নিশাতের মনে বহু বছর ধরে জমে থাকা এক কষ্টের ভার কমে আসে। কারণ নিশাতের জীবনেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল। তার স্বামী ও বাকি পরিবারের কাছে অতি ভালো মানুষ তার দুলাভাই. কলেজে পড়ার সময় সেই দুলাভাই একদিন তার ঘরে ঢোকে এবং সেও পুষ্পের মতো একই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যায়। সে কাকে বলবে? বাবাকে? মাকে? না তার নিজের বড় বোনকে? এই যে কাউকে বলতে না পারা কষ্ট, এই যে সারাজীবন বয়ে বেড়ানো কষ্ট—এর দায়ভার কে নিয়েছে? সমাজ? তার পরিবার? না, দায়ভার নিতে হয়েছে যে ভিক্টিম তাকেই। তবে, নিশাতের মনের জোর দিয়ে নিশাত বেঁচে থেকেছে এবং পরবর্তীতে পুষ্প নামক মেয়েটির জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গিয়েছে। পুষ্পের জয়ে তার নিজের সেই না বলা কষ্টের ভার কমেছে। আর পুষ্প ও নিশাতকে দেখে আমার মনের জোর বেড়েছে। ওদের জন্য আমি কেঁদেছি তবে পুষ্পের জয় আমাকেও জয়ী করেছে। ঠিক এ কারণেই আমি ফিকশন বেছে নিই। কারণ কল্পকাহিনির মধ্য দিয়ে আমি পুরো সমাজটাকে দেখি, পুষ্পকে জিততে দেখি, যেটা বাস্তবে কখনো দেখি না। আমার মনে হয়, নিজের দেশে বাস্তবে এমন কাউকে জিততে দেখলে হাজার হাজার নিশাতের মনে লুকিয়ে রাখা কষ্টের ভার কমবে।
কল্পকাহিনি আমাকে শেখায়, বোঝায়, আমাকে শক্তি দেয়। কল্পকাহিনির নারী চরিত্ররা আমাকে মুগ্ধ করে, আমাকে মুক্তির স্বাদ দেয়, স্বপ্ন দেখতে শেখায়, বলিষ্ঠ কন্ঠে নিজের অধিকার চাইতে শেখায়। বাংলাসাহিত্যে এমন আরোও বলিষ্ঠ নারী চরিত্র আছে যাদের শক্তি সূর্যের আলোর মতোই প্রখর, যে শক্তি ঝলসে দেয় ঘুণ ধরা সমাজকে। আছে বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী, সূচিত্রা ভট্টাচার্যের শ্রবণা, সমরেশ মজুমদারের দীপাবলি ও আরোও অনেকে যাদেরকে এখনো জানা বাকি। দুর্গার সরলতা থেকে শুরু করে সত্য ও সুবর্ণের দীপ্তিমান শক্তি এবং নিশাত ও পুষ্পের হার না মানা—এসবই যেন নারী হিসেবে আমার শক্তি, যে শক্তি নিয়ে আমি দুর্গার মতো মাঠ-ঘাটে ঘুরে বেড়াতে চাই, সত্যবতীর মতো বিদ্যার প্রতি ভালোবাসা চাই। আরও চাই সুবর্ণের মতো কবিতা ও ঝুল বারান্দা, চাই জয়গুনের মতো ভয়কে পাশ কাটাতে। এবং চাই পুষ্পের মতো জয়; সেই জয়ে সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই নিশাতের মতো।