ব্যক্তির চোখ দিয়ে জীবনকে দেখার ক্ষেত্রে একটা পরাবাস্তব জগত নির্মাণের চেষ্টা তাঁর কবিতায় প্রায়শ দেখি।
Published : 18 Mar 2025, 01:10 PM
জাহিদ সোহাগের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, আর চল্লিশ পেরুনো-লগ্নে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই প্রায় শূন্য। সংখ্যার দিক থেকে এটি তাঁর এগারোতম কবিতার বই। এই দুই দিক থেকে বইটির প্রকাশ কবির জন্য একটি বড়ো ঘটনাই বলতে হবে। কারণ জাহিদ সমকালীন কবিতার সক্রিয় তরুণ (?) কবিদের একজন। লেখালেখির শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে কবিতা ও কবিতার আঙ্গিকে রচিত নাটকে নিত্য-নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা লক্ষ্য করা গেছে। কবিকে যে নিজের ভঙ্গি আবিষ্কার করে সেই ভঙ্গিতেই লিখতে হয়, নতুবা তাঁকে গণসম্মিলনে হারিয়ে যেতে হয় এ নিয়ে তরুণ বয়স থেকে সজাগ ছিলেন জাহিদ। এমনটা আমাদের অনুমান নয়, বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছেন কবি নিজেই।
কবিতা লেখা যে জাহিদের সচেতন প্রয়াস-- নিজের জবানিতে প্রকাশিত বইয়ের ফ্ল্যাপেও বলে নিয়েছেন ভিন্নভাবে। প্রকৃত কবি স্বনির্মিত পথেই হাঁটেন। আর হাঁটেন বলে নিজের লেখা নিজেই চুরি করতে বসেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। এটা ভালো না মন্দ সেটা অন্য প্রশ্ন। জাহিদ উদাহরণ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের। অন্যদিকে, আবার পার্থক্যও খুঁজেছেন আর্তুর র্যাঁবো ও শার্ল বোদলেয়ারের জীবন থেকে। তাই সারাজীবনে প্রচুর অপচয় ও অসংখ্য মৃত্যু থেকে আত্মরক্ষার তরিকা হিসেবে নিজেকেই লুট করার পথ বেছে নেন জাহিদ। এতে যেমন নিজস্বতা থাকে, তেমনি থাকে একধরনের অহংকার, কিংবা সুগভীর সংবেদনও। প্রায় শূন্য পড়তে পড়তে সেই আত্মচেতনা, অহংকার ও সংবেদন ধরা পড়ে সহজেই।
পাঠ, অভিজ্ঞতা ও লেখালেখি মিলিয়ে জীবনের চল্লিশ একটি বিশেষ সময়। কবিতার বইয়ের সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো কিছু। সুতরাং সিরিয়াস কোনো কবি যখন এগারোতম কবিতার বই প্রকাশ করেন, তখন তাঁকে সাতপাঁচ ভেবে নিতে হয়। জাহিদও ভেবেছেন প্রচুর। কবির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার সংখ্যাও কমে আসে, এমন নয় যে ব্যবহারিক জীবনের ব্যস্ততার জন্য তা হয়। তখন বরং শিল্পীকে নানা চ্যালেঞ্জের ভিতর দিয়েই যেতে হয়। সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজের প্রতি। জাহিদ সে-চ্যালেঞ্জ অনুভব করেছেন, লিখতে গেলে যেন পুনরাবৃত্তি না-হয়ে যায়। এমন যদি হয় তাহলে না-লেখাই তো ভালো। ফ্ল্যাপে লিখেছেন, ‘সম্প্রতি আমার এমন এক বোধ তৈরি হয়েছে যে, কিছু না লিখেই, কেবল ভেবে ভেবেই, লেখার আনন্দ পাই; তখন আর উদ্যোগ থাকে না কাগজ-কলম বা যন্ত্র খুলে বসতে।’ সৎ শিল্পীর ভাষ্য এটি। শিল্পবোধ পরিণত হলেই এমন ভাবনা আসে। লেখার জন্য লিখে কী লাভ, যদি না তা শিল্প হয়ে ওঠে! কবি জানিয়েছেন এই বইয়ের লেখাগুলো তাঁর অনেক আলোড়নের থেকে ‘একমুঠো’। কিন্তু তাঁর আশঙ্কা হচ্ছে ধীরে ধীরে মুঠি বাড়াবার উদ্যোগও শূন্যে নেমে আসতে পারে! কবির কথায়, ‘তখন পৃথিবীর সমস্ত সাদা কাগজই হবে আমার মুদ্রিত কবিতার পাতা’। সমস্ত দিনের শেষে এ যেন এক বিশেষ পাণ্ডুলিপির আয়োজন। কবি-জীবনে এমনই ঘটে থাকে!
কিন্তু শূন্য হননি জাহিদ সোহাগ। কবিতার মতো তাঁর এসব সংলাপকেও প্রতীকী ধরে নিতে অসুবিধে নেই আমাদের। বড়ো প্রমাণ এই প্রায় শূন্যর কবিতার বিষয়, অ্যাপ্রোচ, ভাষা, ভঙ্গি তথা নির্মাণরীতি। আগের বইগুলো বিশেষ করে অব্যবহিত পূর্বকালে প্রকাশিত রোদের ফালি তরমুজে (২০২২), লুণ্ঠিত একা (২০২৩) প্রভৃতি কাব্যের বিষয় ও শৈলীর মতো এই বইয়েও কবি সমান নিরীক্ষাপ্রবণ এবং এই নিরীক্ষা বিস্তরণশীল। বিস্তরণশীল যে, এতে রয়েছে শিরোনামহীন ৩৭টি কবিতা এবং প্রত্যেকটি কবিতা পূর্ণচ্ছেদহীন। একই সঙ্গে বইটিতে স্থান পেয়েছে ‘কালো নদী’ নামে একটি কাব্যনাটক। তাতেও বিষয়গতভাবে শুধু নয়, শৈলীর নিরীক্ষায়ও পূর্ববর্তী কাব্যনাটকের (যেমন, কবি ও কামিনী) ভাব ও ভাষার বিস্তরণ-লীলা আমাদের চোখ এড়ায় না।
কবিতা বা নাটকে জাহিদের নিজস্ব স্বাক্ষরের প্রয়াস যে শুরু থেকে তা আগেও বলা হয়েছে। সবগুলো বই মিলিয়ে একটা মালার চেষ্টাও আছে, যেটা দিয়ে জাহিদকে শত শত কবির ভিড়ে চিহ্নিত করা সম্ভব, অন্তত আমার তাই মনে হয়। কথা হচ্ছে, জাহিদের এই স্বাক্ষর বা স্বাতন্ত্র্যটা কেমন যা এই বইয়ে আছে? প্রথমেই যেটা বলি, ব্যক্তির চোখ দিয়ে জীবনকে দেখার ক্ষেত্রে একটা পরাবাস্তব জগত নির্মাণের চেষ্টা তাঁর কবিতায় প্রায়শ দেখি। দ্বিতীয়ত দেখা যায়, কবিতায় জীবনের অনুষঙ্গগুলোতে গূঢ় মনস্তত্ত্বের অদ্ভুত রসায়ন। স্বকীয় শব্দপ্রয়োগে সর্বত্র এমনসব চিত্রকল্পের নির্মাণ করেন যা জীবনের গভীর রহস্যকেই উন্মোচন করে। এই চিত্রকল্পগুলো একান্তই জাহিদের। আবার দেখি কাব্যিক গুণ আরোপের ক্ষেত্রে তাঁর কবিতায় অহেতুক জঞ্জাল টেনে আনেন না। তাই কখনো কখনো তাঁর কবিতা নিছক গদ্যের ভাষায়ই হাজির হয়, কিন্তু একে কবিতা হিসেবে মেনে নিতে আমাদের অসুবিধা হয় না। আমার মনে হয় জাহিদ কবিতা ও গদ্যের ভাষার পার্থক্যটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন। পারেন বলে কবিতা ও গদ্যে তালগোল পাকে না। বরং কবিতায় জীবন আরও বেশি সংশ্লিষ্ট হয়ে ওঠে। জাহিদের কবিতার বোধের জগৎটাও তীব্র, এই বোধগুলো শাণিত : ক্রোধের, রিরংসার ও অপ্রমের। এই সবের ভিতরে আবার নৈঃশব্দের মতো লীন হয়ে থাকে প্রেমবোধ এবং জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষার। জীবনের প্রতি সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার নানা নেতিবাচক অনুষঙ্গে কবি আঁকতে পারেন কবিতায় ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের মতো। আমার এখানে যেটুকু বলার তা হলো, জাহিদের কবিতার ভিতরে একজন চিত্রকর লুকিয়ে থাকেন এবং এই চিত্রকর প্রতি-আধুনিক কালের। মিথ্যাকে সত্য বানাবার এই যুগে শিল্পের অনুষঙ্গ ও ভাষা যেমন বৈপরীত্যসূচক হয়, ইমপ্রেশনিস্টদের চিত্রভাষার সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এখাইে। হয়তো কবিতায় এই বৈশিষ্ট্য নিজে একজন চিত্রশিল্পীর হওয়ার কারণেই। শব্দে অঙ্কিত এমন চিত্র ও প্রতিভাস একটি কবিতায় এভাবে উঠে এসেছে : ‘আমি ও আমার শরীর দুদিকে টুকরো হয়ে আছি; যেন তারা স্বতন্ত্রই/ ছিল প্রেম ও রিরংসার চাবুক শূন্যে ওঠার আগেও;/তুমি ফুল গাছে ঢেলে দাও বিরক্তি; শিশুকে ঘৃণা; খেতে বসো/মর্গের টেবিলে; আর লাল পিঁপড়া তোমার প্রশ্রয়ে ফিরে যায় কাঁকড়ার জীবনে;/নিজের দুর্গন্ধ থেকে জেগে, আমারও মনে হয় ঝুমবৃষ্টি ওই তো/কলাঝোপে; পাতাগুলো মোচার মতো নত হয়ে ভিজছে; তার আগে/ বুনোলতার প্ররোচনা দেখে আমি দাঁড়িয়ে থাকি;/আমার পায়ের কাছে পুরাতন ইঞ্জিন জেগে উঠতে বারবার গর্জন করে;’। কবির উপলব্ধ বোধগুলো চিত্রে ও রঙে এভাবে প্রতিকায়িত হয়ে ওঠে যে তাঁর কবিতা আধুনিক জীবনের গভীর সংবেদ হিসেবেই ধরা পড়ে। মানুষের দুর্মর যৌন-অনুভব ও মানব-অস্তিত্বের বহুমাত্রিক চৈতন্য জাহিদের কবিতায় শুরু থেকে যেমন প্রতীকায়িত হয়েছে, প্রায় শূন্যতে তার একটা পরিমিতি ও সংহত রূপও দেখা যায়।
সমানভাবে কালো নদী কাব্যনাটকে মানব-মানবীর ঐন্দ্রজালিক সম্পর্কের পরিণতি ও মানব-অস্তিত্বের বিষণ্ণ শূন্যতাবোধের যে প্রকাশ দেখি তা কবি ও কামিনীর ভাবেরই পরিণত রূপ হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব। রহস্যময় গল্পের প্রেক্ষাপটে আদিগুল্মময় বাস্তবতায় মানব-অস্তিত্বের রূপান্তরের এমন প্রতীকী ও কাব্যিক প্রয়াস সত্যি উপভোগ্য। সবমিলিয়ে প্রায় শূন্যকে একটি পরিণত ও প্রতিনিধিত্বশীল রচনা হিসেবে ভাবা যেতে পারে। এমন রূপ শৈলীর রচনা নিয়ে কবির আবর্তন আবারও হোক এই প্রত্যাশা।
প্রায় শূন্য: জাহিদ সোহাগ, প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০২৪, প্রকাশক : অনুবাদ, ঢাকা, প্রচ্ছদ : জাহিদ সোহাগ, মূল্য : ১২৫ টাকা।