Published : 14 Jun 2012, 03:06 PM
গত ১৫ মে চলে গেলেন মেহিকোর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঔপন্যাসিক গল্পকার ও প্রাবন্ধিক কার্লোস ফুয়েন্তেস। পৃথিবীর নানান ভাষী লেখক, সমালোচক ও গুনগ্রাহী পাঠক এই অসামান্য লেখকের মৃত্যুতে প্রকাশ করেছেন শোক, স্মৃতিচারণ করেছেন তার ব্যক্তিত্ব ও উপস্থিতির।
মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক লিন্টন উইকসের এই লেখাটি গত ১৬ মে NPR পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখাটি অনুবাদ করেছেন প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক এহসানুল কবির।
মেহিকোর সাহিত্যিক কিংবদন্তি কার্লোস ফুয়েন্তেস গত মঙ্গলবারে ৮৩ বছর বয়সে মারা গেছেন শুনে বহু বছর আগে আমার নেওয়া তাঁর একটি সুদীর্ঘ, সাবলীল সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে গেল । আমরা অনেক কিছু নিয়ে কথা বলেছিলাম—নিজের কবরের প্রস্তরফলকে এপিটাফ হিসাবে তিনি কী চান, তা নিয়েও।
১৯৯৫ সালের শরৎকালের কথা। আমি তখন দি ওয়াশিংটন পোস্ট এর প্রতিবেদক, মার্জিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সুভাষী ফুয়েন্তেসের ওপরে একটি নিবন্ধ লিখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। অধিকন্তু ন দোষায় বিধায় এখন আমি সেই গল্পটারই রেশ টানছি।
তিনি ওয়াশিংটন ডি. সি.-তে এসেছিলেন স্মিথসোনিয়ান ইন্স্টিট্যুশনে মেহিকান কালচারাল ইন্স্টিট্যুট পুরস্কার নিতে এবং তাঁর ন্যূনাধিক দুই ডজন উপন্যাসের কোন একটি থেকে পাঠ করে শোনাতে।
পুরস্কার-প্রদান অনুষ্ঠানটা হয়েছিল ১৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত কালচারাল ইন্স্টিট্যুটে, যেখানে একসময় মেহিকোর দূতাবাস ছিল। ফুয়েন্তেস বলেছিলেন যে ঐ অনুষ্ঠানটা তাঁর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কেননা এটা এমন এক জায়গায় হচ্ছিল প্রায় ৬০ বছর আগে যেটা তাঁর বসবাস ও খেলার জায়গা ছিল। ফুয়েন্তেস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তাঁর বাবা ওয়াশিংটনে মেহিকান কূটনীতিবিদ হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
এক পর্যায়ে, কাছেরই একটা দেওয়ালের ওপরে অনেক পুরনো একটি দেওয়াল-চিত্রের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ফুয়েন্তেস। সেটা ছিল মেহিকোর প্রগতির একটা বিস্তীর্ণ প্রদর্শনী। ঘোড়সওয়ার কিছু সুদর্শন নারী ও পুরুষ সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একটা দীর্ঘ মেঠোপথে। সম্মুখপটে আছে একদল শিশু। বিস্তীর্ণ মাঠের ভেতরে প্রবেশমান একসারি ট্রাক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। গায়ে আলখাল্লা আর মাথায় খড়ের টুপি পরা ছোট্ট ছেলেটি ছাড়া, সবাই।
দেওয়ালচিত্রের সবগুলো চরিত্রের মধ্যে কেবল ঘন-কালো চুলের ঐ ছোট্ট ছেলেটাই তাকিয়ে ছিল অন্যদিকে। সে তাকাচ্ছিল পাশের বেণীদোলানো সুন্দরী মেয়েটার দিকে। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল দর্শকদের ওপরে।
সেই ছোট্ট ছেলেটার মডেল ছিলেন, ফুয়েন্তেস আমাকে বলেছিলেন, কার্লোস ফুয়েন্তেস স্বয়ং।
সবকিছুর শেষ ঠিকানা সাহিত্য
শেষ পর্যন্ত তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কূটনীতিবিদ হন এবং, বন্ধু গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সহ, তাঁর প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকে পরিণত হন। ফুয়েন্তেসের বইগুলো—তাঁর ব্যক্তিসত্তার মতোই—যৌবন ও বার্ধক্য, রাজনীতি, দর্শন, জনসংস্কৃতি এবং যৌনতার সমন্বয়।
দি পোস্ট-এ তাঁর সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম যে তিনি চলচ্চিত্রের নায়কের মতো অভিজাত ও সুদর্শন। লেবুর সৌরভযুক্ত সুগন্ধী ব্যবহার করতেন। মাথার দু'পাশে পেছন দিকে আঁচড়ানো তাঁর চুল, যেমনটা তখন লিখেছিলাম, দেখতে মতো হতো যেন দুই কানের ওপরে দুটো রূপালী ডানা। গোঁফ ছিল অত্যন্ত পরিপাটি। তাঁকে দেখতে উইলিয়াম ফক্নার কিংবা ক্যাসাব্লাঙ্কার ক্লদ রেইন্স্-এর মতো লাগতো আমার কাছে।
আমাদের একসঙ্গে কাটানো সময়টাতে, যার ব্যাপ্তি ছিল বেশ কয়েক দিনের, নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে: কাউকে বর্ণনা করার কৌশলটা কী? "আমি প্রচুর চলচ্চিত্রীয় ইমেজ ও উপমা ব্যবহার করি," তিনি বলেন। "আর কল্পনা।"
জানতে চেয়েছিলাম যৌনতা সম্পর্কে তাঁর লেখকসুলভ মুগ্ধতার বিষয়ে। "যৌনতা তাঁর কাছে," ফুয়েন্তেস বলেন, "জীবনের অন্য সবকিছুর মতোই সাহিত্যে পৌঁছানোর একটা পথ। সাহিত্য ছাড়া এর কোনো মূল্য নেই। আমি একটা সাহিত্যিক জীব। আমার কাছে, সবকিছুর শেষ ঠিকানা সাহিত্য।"
মার্থাস ভাইনইয়ার্ড-এ অবস্থিত লেখক উইলিয়াম স্টায়রনের বাগানবাড়িতে তাঁর সম্প্রতি কাটানো সময়ের কথা বলেছিলেন তিনি। সেখানে স্টায়রন, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্নিনটন এবং গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে খাচ্ছিলেন ফুয়েন্তেস। তিন লেখকের কাছে ক্লিনটন জানতে চান কোন্ বইটি লিখতে পারলে কৃতার্থ বোধ করতেন তাঁরা। স্টায়রন বলেন দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স্ অভ হাকলবেরি ফিন। মার্কেস বলেন দ্য কাউন্ট অভ মন্তে ক্রিস্তো। "আমি প্রায় বলে ফেলেছিলাম দন কিহোতে," ফুয়েন্তেস আমাকে বলেন। "কিন্তু আমি প্রেসিডেন্ট মশায়কে দক্ষিণে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তাই জিভ কামড়ে বলি অ্যাবসালম, অ্যাবসালম।"
দুষ্টুমিভরা একধরনের রসবোধ ছিল ফুয়েন্তেসের।
আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম বিংশ শতাব্দীর সেরা পাঁচ জন ঔপন্যাসিকের নাম করতে। তিনি বেছে বেছে কেবল মৃতদের নামই বলেছিলেন:
ফ্রান্জ্ কাফকা। "কাফকা না পড়লে বিংশ শতাব্দীকে বোঝার আশায় গুঁড়ে বালি।"
উইলিয়াম ফক্নার। "মহান ট্রাজিক লেখক। লাতিন আমেরিকান লেখকদের মধ্যে আমি কেবল তাঁর নামই বলব," বললেন তিনি এবং হাসলেন।
জেম্স্ জয়েস। "ভাষার সমস্ত ধরনের সম্ভাবনার, জগতকে ভাষার মধ্য দিয়ে পুনরাবিষ্কারের দুয়ার খুলে দিয়েছেন তিনি।"
টমাস মান। "বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য হল জার্মান সাহিত্য। আর ইনি জার্মান সাহিত্যের পুরোধা পুরুষ।"
আর ৫ নম্বরে কে? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। "আমার মনে হয় আমি বরং একটা খালি জায়গা রাখব," বললেন তিনি আর খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে একটু নড়েচড়ে বসলেন।
কোনো অতিনাটকীয়তা নয়
তাঁর ওয়াশিংটনে স্মৃতিভারাতুর এক ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম আমরা। গাড়ি চালিয়েছিলাম আমিই, কারণ ফুয়েন্তেস বলেছিলেন তিনি গাড়ি চালাতে জানেন না। আমরা তাঁর শৈশবের এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি আর তিনি বিষাদভরে স্মৃতিচারণ করে গেছেন সেই বাড়িগুলোর যেখানে তাঁর পরিবার থাকতো, সেই পার্কগুলোর যেখানে তিনি খেলতেন, সেই স্কুলের যেখানে তিনি পড়েছিলেন আর সেই প্রেক্ষাগৃহের যেখানে তিনি প্রতি শনিবার ছবি দেখে কাটাতেন।
শারদাকাশে সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছিল তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কীভাবে মৃত্যুকে বরণ করতে চান তিনি। "আরামে, ঘুমের ভিতরে," তিনি বলেন। "কোনো অতিনাটকীয়তা চাই না আমি। সবাইতো শান্তিতেই মরতে চায়।" তিনি মারা যান মেহিকোর নগর হাসপাতালে।
ফুয়েন্তেস বলেছিলেন তাঁরা কোথায় কবরস্থ হতে চান সে-ব্যাপারে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সিলবিয়া লেমুস আলোচনা করেছেন। তখন ফুয়েন্তেসের ইচ্ছা ছিল পারী-র মঁপারনাসে কবরগাহে সমাহিত হওয়ার। "আমার মনে হয়," তিনি বলেছিলেন, "অনন্তকাল কাটানোর জন্য সেটা একটা চমৎকার জায়গা।"
আমি জিজ্ঞেস করি, সমাধি-ফলকের ওপর কী লেখা চান আপনি? বলেছিলেন এর উত্তর দেওয়ার আগে তিনি আরেকটু ভাবতে চান।
সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার পরে ফুয়েন্তেস বললেন তাঁকে ডুপন্ট সার্কেলের "কফির দোকান-ওয়ালা সেই বইঘরের" কাছে নামিয়ে দিতে।
ক্র্যাম্বারবুক্স্-এ লোকজন কি আপনাকে চিনতে পারবে? তাঁকে জিজ্ঞেস করি। "আমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার আগ পর্যন্ত না," তিনি বলেন।
তিনি গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলে আমি ফুটপাথে উঠে আসি তাঁর চলে যাওয়াটুকু দেখার জন্য। মুহূর্তের জন্য থামলেন তিনি, তখনো আমার শ্রবণসীমার ভিতরে, এবং সমাধি-ফলকের ব্যাপারে আমার করা প্রশ্নের উত্তর দিলেন গলা উঁচিয়ে: "লোকটা যেন কে, যে বলেছিল 'এটা আমার জন্য একটু বেশি গভীর'?"