এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।
Published : 08 Apr 2025, 01:32 AM
বিতর্ক আর আলোচনা-সমালোচনা সঙ্গী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
আয়োজন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বার্তা দেবে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা।
অন্যদিকে চারুকলা অনুষদের ২৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এবারের বৈশাখের আয়োজনকে ‘স্বজনপ্রীতিদুষ্ট ও দেশের পরিবর্তনকালীন সময়ে রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী’ আখ্যায়িত করে চারুকলার এই আয়োজন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
ফলে মঙ্গল শোভাযাত্রা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সন্দিহান কেউ কেউ। চারুকলার রীতি অনুযায়ী এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল ২৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম চঞ্চল অবশ্য বলছেন, “আনন্দঘন পরিবেশে এবারও বাংলা নতুন বছরকে বরণ করা হবে। ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়েই চারুকলার শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশের অনেক গুণী শিল্পীও যুক্ত হয়েছেন মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে। পুরোদমে চলছে প্রস্তুতির কাজ।”
তার ভাষ্য, ৬০ শতাংশের বেশি কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজও যথা সময়ে শেষ হবে। ১১ এপ্রিলের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
চারুকলায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ-বেতের কারুকাজে দুই শিংওয়ালা দৈত্যের আদলে তৈরি করা হচ্ছে স্বৈরাচারের প্রতীক। এটাই এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল মোটিফ বা অবকাঠামো হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইতোমধ্যে চারটি মোটিফের অবয়ব নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিল্পীর তত্ত্বাবধানে চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রধান মোটিফ বা অবকাঠামো নির্মাণের কাজ।
তবে অন্য বছরের মত এবার বর্তমান শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুব একটা নেই। আনন্দ-উচ্ছ্বাসেও যেন কিছুটা কমতি রয়েছে।
নাম নিয়ে সংশয় কাটেনি এখনো। এবারের আয়োজনটির নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাকি ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি আয়োজন সংশ্লিষ্টরা।
নাম পরিবর্তনের গুঞ্জন
গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল; সেটিই পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপ নেয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এ কর্মসূচি।
গত ২৩ মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপন সংক্রান্ত এক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়নি।”
নাম পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে চারুকলার ডিন আজহারুল ইসলাম বললেন, “আয়োজনটি নিয়ে বিভিন্ন কমিটি ও উপকমিটি রয়েছে। সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত থেকেই সবকিছু চূড়ান্ত করা হবে। নাম পরিবর্তনের কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।”
এখন কী মঙ্গল শোভাযাত্রা, নাকি আনন্দ শোভাযাত্রা নামে প্রস্তুতির কাজ চলছে– এমন প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক আজহারুল বলেন, “আমরা সব কিছু চূড়ান্ত করে সাংবাদিকদের জানাব। যে মোটিফগুলো তৈরি হয়েছে, তা কীভাবে উপস্থাপন করা হবে। পুরো আয়োজনটি কীভাবে হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে, তা সবাইকে জানানো হবে।”
এ বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টার বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে, তিনি ফোন ধরেননি। জাতীয়ভাবে নববর্ষ উৎসব ১৪৩২ উদযাপন সামনে রেখে মঙ্গলবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন স্থগিতের বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টার একান্ত সচিব মুকতাদিরুল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংবাদ সম্মেলনটি আরো বড় পরিসরে করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সময় চাওয়া হয়েছে, সেখান থেকে তারিখটি চূড়ান্ত হলে সবাইকে জানানো হবে।”
আয়োজনে যা যা
শোভাযাত্রার মোটিফের মধ্যে স্বৈরাচারের প্রতিকৃতি, বড় আকৃতির একটি ইলিশ মাছ, সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের কাঠের বাঘ আর শান্তির পায়রার নির্মাণকাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন শিল্পীরা। বাঁশ-কাঠের কাজ প্রায় শেষ। এখন চট বা কাপড় বসিয়ে তাতে রং লাগিয়ে চূড়ান্ত করা বাকি।
ফ্যাসিস্টের দৈত্যাকৃতির প্রতিকৃতির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। ইলিশ মাছ, বাংলার বাঘ ও পায়রার উচ্চতা হবে ১৬ ফুট। চারটি মোটিফের পাশাপাশি মীর মুগ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে একটি পানির বোতলও তৈরি করা হতে পারে।
তবে কোন মোটিফ শেষ পর্যন্ত থাকবে কিংবা কোন মোটিফ কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে বলে জানালেন চারুকলার ডিন।
তিনি বলেন, “আমরা পাঁচ থেকে ছয়টি মোটিফ করার কাজ করছি। সবকিছু চূড়ান্ত করেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলব।”
শোভাযাত্রার কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, হাতি, বাঘ, পেঁচাসহ পশুপাখির মুখোশও থাকবে। চারুকলা প্রাঙ্গণে এখন সেসব মুখোশ তৈরি হচ্ছে।
এছাড়া চারুকলার সীমানা প্রাচীর সাজানো হচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির নকশা দিয়ে। ফুল-পাখি-লতাপাতা দিয়ে নান্দনিক করে তোলা হচ্ছে দেয়াল।
চারুকলার বকুলতলায় বিগত বছরের মত এবারও বাংলা বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান থাকবে। বিকেল ৪টা থেকে নাচ-গানের এ আয়োজন চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত। থাকবে যাত্রাপালার মঞ্চায়নও।
এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।
এই প্রতিপাদ্য ধারণ করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হবে আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সেই সঙ্গে গতবছর জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে ‘ফ্যাসিবাদকে’ বিদায় জানানো হয়েছে, সেই ফ্যাসিবাদের উত্থান যেন এই দেশে আর না হয়, সে প্রত্যাশাও ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে আয়োজন সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য।
আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ের পর আমরা চাই না এই দেশে আর কোনো রকম ফ্যাসিবাদের উত্থান হোক। ২৪-এর স্পিরিটকে ধারণ করে আমাদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্য আছে, তা তুলে ধরা হবে।”
শিক্ষার্থীদের বর্জন
চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট ব্যাচের তত্ত্বাবধানে এবং সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যৌথ প্রয়াসে আয়োজিত হয়। আয়োজনের সম্পূর্ণ অর্থ সংগ্রহ করা হয় অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের শিল্পকর্ম বিক্রির মাধ্যমে।
রীতি অনুযায়ী যা এ বছর ২৬ ব্যাচের করার কথা। তবে ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, “এবারের আয়োজন একেবারেই চারুকলা অনুষদের পূর্বাপর রীতির ব্যতিক্রমীভাবে কোনোরকম শিক্ষার্থীদের সম্মতি ও সম্পৃক্ততা ছাড়া শুধুমাত্র শিক্ষকদের সিদ্ধান্তে করা হচ্ছে, যা আমাদের বিশ্বাস ও ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
“এছাড়া এবার একাডেমিকভাবে বৈশাখ আয়োজন করার এই সিদ্ধান্ত অনুষদে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, ছাত্র প্রতিনিধি কারো সাথে কোনোরকম পূর্ব আলোচনা ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট ছাত্র-শিক্ষক গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততায় খুবই অতর্কিতভাবে নেওয়া হয়েছে।”
গত ২৬ মার্চ দেওয়া বিবৃতিতে ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বলছেন, “এবারের বৈশাখ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈশাখ। এ আয়োজনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের চাটুকারিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণে আমরা শিক্ষকদের আয়োজন করা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা ও শোভাযাত্রা সমর্থন করছি না।”
এ বিষয়ে চারুকলার ডিন আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, “২৬ ব্যাচ এখন প্রাক্তন, তারা এখন আর রানিং শিক্ষার্থী নন। আর রানিং শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজের সঙ্গে আছেন।”
চারুকলা অনুষদের একজন শিক্ষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থীরা যে অভিযোগ তুলেছে, সেটা ঠিক আছে। এবার অনেক বেশি রাজনৈতিক হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। এতে সবার অংশগ্রহণের যে স্বতস্ফূর্ততা, তা নষ্ট হয়ে গেছে।”
২৬তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের ব্যাচ এবং পুরো চারুকলার সাধারণ শিক্ষার্থীরা বর্জন করেছি। আমাদের শিক্ষকেরা অতিমাত্রায় চাটুকারিতা করছেন। এজন্যই এবারের আয়োজনের সঙ্গে আমরা নাই।”
‘আবু সাঈদের মোটিফ’ বিতর্ক
এবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় জুলাই আন্দোলনে নিহত রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানোর আদলে একটি মোটিফ করা হবে বলে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়ানোর পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে আয়োজন সংশ্লিষ্টরা।
২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিবৃতিতে বলেছেন, “শোভাযাত্রায় বানানো স্ট্র্যাকচারের ডিজাইন এবং আইডিয়া সম্পূর্ণ শিক্ষকদের দেওয়া, চারুকলার আপামর সাধারণ শিক্ষার্থী এর সাথে কোনোভাবেই সংযুক্ত এবং অবগত না।
“শহীদ আবু সাঈদের আকৃতি সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম না এবং কারো ব্যক্তিগত মতাদর্শে আঘাত দেওয়ার পক্ষেও না আমরা। এহেন কুরুচিপূর্ণ ও প্রহসনমূলক সিদ্ধান্ত চারুকলার সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ আলোচনা করে নেওয়া হয়নি এবং চারুকলার সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই সিদ্ধান্তের সাথে ছিল না।”
“অতএব এর জন্য অনলাইনে তৈরি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দায় সমগ্র চারুকলার নয় বরং দায়িত্বে থাকা নির্দিষ্ট কতিপয় আয়োজক এবং ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ওপর বর্তায়।”
চারুকলার ডিন আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, “এটা প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জুলাই আন্দোলনকে কীভাবে বর্ষবরণের উদযাপনে যুক্ত করা যায়, তার প্রেক্ষিতে এটা আলোচনা হয়েছিল। একটা খসড়া সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আমরা আবু সাঈদের মোটিফটি বাদ দিয়েছি। এটি থাকছে না।”
আগের খবর
মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্জনের সিদ্ধান্ত চারুকলার ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের
মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়নি: সংস্কৃতি উপদেষ্টা
বর্ষবরণ হবে 'অন্তর্ভুক্তিমূলক', মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলের ইঙ্গিত