পশ্চিমবঙ্গে কেমন করে ইলিশ এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তা বোঝার জন্য ১৯৪৭ সালের বঙ্গ বিভাজনের পরবর্তী জনসংখ্যাগত পরিবর্তনগুলোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
Published : 11 Apr 2025, 08:27 AM
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইলিশকে তাদের ‘রাজ্য মাছ’ হিসেবে ঘোষণা করে– যা রাজ্যের খাদ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই সিদ্ধান্তটি ইলিশকে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তুলে ধরলেও এটি গভীরতর ঐতিহাসিক, জনমিতিক ও সাংস্কৃতিক জটিলতার মতো দিকগুলোকেও স্পষ্ট করে সামনে নিয়ে আসে। ইলিশকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মাছের (স্টেট ফিস) প্রতীকে ভূষিত করলেও এর মূল শিকড় ‘পূর্ববঙ্গে’ (বর্তমান বাংলাদেশে)। পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের গ্রহণযোগ্যতা মূলত পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া একটি ‘সাংস্কৃতিক ঋণ’ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা ১৯৪৭ সালের বঙ্গ বিভাজনের সময় এবং পরে বিপুল সংখ্যক পূর্ববঙ্গীয় মানুষের ‘অভিবাসন’ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে বলেও ধারণা করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ইলিশের প্রতি এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মূলত একটি এমন ঐতিহ্যের স্বীকৃতি, যা সীমান্তের এপারে (পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশে) উদ্ভূত হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে নয়।
অভিবাসন ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে কেমন করে ইলিশ এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তা বোঝার জন্য ১৯৪৭ সালের বঙ্গ বিভাজনের পরবর্তী জনসংখ্যাগত পরিবর্তনগুলোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি। ঐতিহাসিকভাবে, পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ ছিল ইলিশ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা তো বটেই, ছোট বড় নদনদীগুলোর পানি ইলিশের প্রধান উৎস ছিল যুগ যুগ ধরে, যা ইলিশকে পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছে। পূর্ববঙ্গে ইলিশ শুধুমাত্র খাদ্য নয়, এটি একটি ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক’, যা গভীরভাবে অঞ্চলটির নদী, উৎসব ও পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। ভাজা, সেদ্ধ, বা বাটা সরষের রান্না করা যেভাবেই হোক না কেন, ইলিশ হলো এমন একটি রন্ধনপ্রণালী যা মানুষ, প্রকৃতি এবং সমাজের সংযোগকে নিবিড়ভাবে উপস্থাপন করে।
বঙ্গ বিভাজনের সময় পূর্ববঙ্গীয় অধিবাসীরা পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নেয়, তারা শুধুমাত্র ইলিশের প্রতি তাদের ভালবাসা নয়, বরং তাদের সম্পূর্ণ খাদ্যসংস্কৃতি বা খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যায়। এই শরণার্থীরা, যাদের ‘বাঙ্গাল’ বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঐতিহ্য স্থানীয় ‘ঘটি’ (স্থানীয় পশ্চিমবঙ্গীয়) সংস্কৃতির সঙ্গেও মিশে যেতে শুরু করে। এই সাংস্কৃতিক মিশ্রণের প্রক্রিয়ায়, পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, যদিও রাজ্যের নদীগুলো ঐতিহাসিকভাবে ইলিশের জন্য বড় উৎস ছিল না কোনোদিনও।
পূর্ববঙ্গীয় অভিবাসনের ঢেউ পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নাটকীয়ভাবে পুনর্গঠন করেছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ইলিশকে তাদের রাজ্য মাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া মূলত একটি ‘সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার’ প্রক্রিয়ার প্রতিফলন। পশ্চিমবঙ্গ ইলিশকে গর্বের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে দাবি করলেও, এটি মূলত পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ বাংলাদেশের ঐতিহ্য। ইলিশকে রাজ্য মাছ প্রতীকে সম্মানিত করার সিদ্ধান্তটি পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক নিজস্ব সংস্কৃতির চেয়ে ‘অভিবাসন এবং পূর্ববঙ্গীয় শরণার্থীদের সংহতকরণ তথা বাঙালি বিভাজন, (বাঙ্গাল-ঘটি) বিরোধ রোধে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক পরিচয়ে কতটা প্রভাব ফেলেছে তারই একটি প্রতিফলন।
জনমিতিক জটিলতা ও সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা
এই জটিলতার সঙ্গে আরও একটি বিষয় হল যে, পশ্চিমবঙ্গের জনগণের একটা বড় অংশ অবাঙালি। বাংলাদেশও শতভাগ বাঙালির দেশ নয়। তবে বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে অন্য ভাষার মানুষের সংখ্যা খানিকটা বেশি, তবে বাংলাভাষিরা ওখানেও সংখ্যাগরিষ্ঠ।ওই রাজ্যের জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিভিন্ন অ-বাঙালি জাতিগোষ্ঠী, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুণ্ডা ইত্যাদি জাতিসত্তার মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে মারোয়াড়ি, বিহারি, নেপালি এবং উর্দুভাষি মুসলিমও রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে এই সম্প্রদায়গুলোর খাদ্যসংস্কৃতিতে ইলিশের স্থান আদৌ ছিল কিনা তা চর্চার বিষয়। তবুও, পূর্ববঙ্গীয় অভিবাসনের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে, ইলিশ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ‘একত্রীকরণের প্রতীক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা জাতভেদ উপেক্ষা করে ‘বাঙালি পরিচয়ের’ প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এখানে আরও বলা যেতে পারে, ইলিশ ছাড়া আর কোনো মাছকে তাদের খাদ্যাভ্যাসের প্রতীক করার মতন কোনো উপকরণ আদৌও ছিল বা আছে কি না! পূর্ববঙ্গের ইলিশ যেমন একেবারে নিজস্ব, প্রাচীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে আলু-পোস্ত হয়তো স্বকীয়। কেননা অনেক আগে থেকেই পোস্ত বা পপি গাছের আবাদ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু এই আলুপোস্তকে ঘটি সংস্কৃতির উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে। ধর্মীয়ভাবে আমিষ এবং নিরামিষের ব্যাপারটা যেহেতু প্রকট আর এই আলুপোস্ত নিরামিষ হওয়ার কারণে এর জনপ্রিয়তার যথেষ্ট কারণও আছে। কিন্তু মাছে-ভাতে বাঙ্গাল বা বাঙালির প্রবাদে মাছ কে ছেটে ফেললে যে বাঙালিয়ানা খাটো হয়ে যায়। এই বাস্তবতা থেকেই হয়তো ঈষৎ আধুনিক এই সংস্বৃতি পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান হয়ে পড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে থাকা এই অ-বাঙালি গোষ্ঠীগুলোর জন্য, ইলিশকে তাদের খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করা বৃহত্তর বাঙালি সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে একীভূত হওয়ার একটি উপায়। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে যুক্ত থাকা এই মাছটি এখন পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে একত্র করে এমন একটি ‘রন্ধনসম্পর্কীয় সেতু’ হিসাবে কাজ করছে, যা রাজ্যের আধুনিক পরিচয়ে পূর্ববঙ্গীয় ঐতিহ্যের শক্তিশালী প্রভাবকে প্রতিফলিত করেছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সুতরাং, যদিও পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময়, ইলিশ এক প্রতীকী উপাদান হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যা এই জাতিগত বৈচিত্র্যকে ছাপিয়ে সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বনাম ধর্মীয় প্রতীক
পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গে ইলিশকে কীভাবে দেখা হয় তার মধ্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল এর ‘প্রতীকী গুরুত্ব’। পূর্ববঙ্গে, ইলিশের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মূল্য খুবই গভীর। এটি দৈনন্দিন জীবনের অংশ, যা মানুষের সঙ্গে তাদের পরিবেশের সম্পর্ককে উপস্থাপন করে। পূর্ববঙ্গের নদীগুলো ইলিশ সংস্কৃতির মূল এবং এই মাছটিকে সেখানে একটি ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়, যা গ্রামীণ জীবনের সরলতা এবং ঐশ্বর্যকে প্রতিফলিত করে। পূর্ববঙ্গে ইলিশকে প্রধানত সাংস্কৃতিক দিক থেকে উদ্যাপন করা হয়, এর গুরুত্ব ধর্মীয় নয়।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের একটি ধর্মীয় গুরুত্ব যুক্ত হয়েছে। ইলিশ ‘দুর্গাপূজার’ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। দুর্গাপূজার সময় ইলিশকে দেবী দুর্গার কাছে প্রসাদ হিসেবে উৎসর্গ করা হয় (কবে থেকে এর সূচনা তা আমার জানা নেই), যা এই মাছটিকে কেবল খাদ্যসামগ্রী থেকে একটি ‘পবিত্র প্রতীকে’ উন্নীত করে। দুর্গাপূজার মতো উৎসবের সঙ্গে ইলিশের ধর্মীয় সংযোগ পূর্ববঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গির থেকে একেবারেই ভিন্ন, যেখানে ইলিশের মূলত সাংস্কৃতিক মূল্য রয়েছে, ধর্মীয় নয়। তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো দুর্গা পূজায় ইলিশ অনুসঙ্গটির উৎপত্তিতে ‘অরন্ধন’ পূজার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, কেননা এই পূজায় ইলিশের ব্যবহার আরও প্রাচীন। অরন্ধন পূজা হল একটি ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পূজা যেখানে পূজার দিন কোনো রান্নাবান্না হয় না, হয় তার আগের রাতে এবং তাকে ঠাণ্ডা করে রাখা হয়। পূজার প্রথাগত নিবেদনে রান্না করা ইলিশের প্রচলন রয়েছে হালের দুর্গা পূজার আগে থেকেই। বিশেষ করে কায়স্থ সম্প্রদায়ের মধ্যে যা পালিত হয়। এটি দেবী শীতলাকে পূজা করার উদ্দেশ্যে করা হয়, যাতে রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এখানের সেই একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হতে পারে যে, এই ইলিশের আগমন বঙ্গ বিভাজনে পশ্চিমবঙ্গে আগত পূর্ববঙ্গীদের অবদান।
পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের এই ধর্মীয় প্রতীকীকরণ দেখায় কীভাবে সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা রীতিনীতির বিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদিও পূর্ববঙ্গীয়রা অভিবাসনের সময় তাদের ইলিশের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে যায় নিতান্ত অভ্যাসগতভাবে, এই মাছটি পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথায় মিশে গেছে, যার ফলে এর মূল রন্ধনসম্পর্কীয় উৎপত্তির বাইরে আরও বিস্তৃত অর্থ অর্জিত হয়েছে। ইলিশ শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠেনি, এটি ‘আধ্যাত্মিক ভক্তির’ প্রতীকও হয়ে উঠেছে, যা রাজ্যের সাংস্কৃতিক পরিচয়ে ‘হিন্দু ঐতিহ্য’ এবং পূর্ববঙ্গীয় প্রভাবগুলির অনন্য সংমিশ্রণকে প্রতিফলিত করে।
সীমান্ত বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের বাণিজ্য ও প্রাপ্যতা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে। ইলিশ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও প্রধান দেশ, যা বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। এবং একটি সামুদ্রিক এবং মিঠা পানির মাছ। ব্রিটিশ গবেষক হ্যামিল্টন বুখানন ১৮৮২ সালে বঙ্গোপসাগরে মাছ গবেষণার সময় ইলিশ (হিলশা) মাছের নামকরণ করেন।
দুর্গাপূজার মতো উৎসবের সময় পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। ইলিশকে ঘিরে ‘হিলশা ডিপ্লোমেসি’ যেখানে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের সময় ইলিশ সরবরাহ করে এই মাছের সীমান্ত-বাণিজ্য সম্পর্কের প্রতীকী মূল্যকেও প্রতিফলিত করে। এই রপ্তানিকরণের ইতিহাসও খুব প্রাচীন নয়। খুব সম্ভবত ২০১২ সাল থেকে এর সূচনা। এই প্রক্রিয়া আরও একবার প্রমাণ করে যে, পশ্চিমবঙ্গ ইলিশকে তাদের রাজ্য মাছ হিসেবে গ্রহণ করলেও, তারা এই মূল্যবান মাছের উৎপাদনের জন্য পূর্ববঙ্গের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা শুধু মাত্র বাণিজ্য নির্ভর নয়, সাংস্কৃতিকও বটে।