আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলোয় অনেক ভালো এবং দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশের কথা বলা হলেও জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়টি সেভাবে এসেছে বলে মনে হয় না।
Published : 10 Apr 2025, 05:58 PM
‘সংস্কার’ শব্দটি এখন ভীষণভাবে আলোচিত। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে অন্তর্বর্তী সরকার যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তার মধ্যে ছয়টি কমিশন এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে— যেগুলো জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন, জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য প্রতিটি কমিশনই অনেকগুলো সুপারিশ দিয়েছে। সবগুলো সুপারিশের বিষয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলো একমত নয়, সেটিও লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে বিএনপি অনেকগুলো সুপারিশের বিষয়ে তাদের ভিন্নমত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। মত ও ভিন্নমতের এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করাও একটি বড় সংস্কার।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে জবাবদিহির সংস্কৃতি চালু করা। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি ও জনকর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
‘জবাবদিহি’ কাকে বলে সেটি বোঝার জন্য ইউটিউবে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ক্যাশ প্যাটেল (এফবিআই প্রধান), তুলসী গাবার্ড (ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক), জন র্যাটক্লিফ (সিআইএ প্রধান) এবং জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ এডমিরাল ক্রিস্টোফার গ্রেডির জবাবদিহির উদাহরণটি দেখা যেতে পারে।
আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলোয় অনেক ভালো এবং দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশের কথা বলা হলেও জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়টি সেভাবে এসেছে বলে মনে হয় না।
জবাবদিহি মূলত তিনটি প্রশ্নের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব।
১. কেন জবাবদিহি প্রয়োজন? চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে যে ফারাক তা জানা প্রয়োজন। পরিকল্পিত কাজ এবং তা বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ জনসাধারণের জানার অধিকার থেকেই জবাবদিহি প্রয়োজন।
২. জনগণ কখন জবাব চাইবে? যখনই মনে হবে বা উদ্ঘাটন হবে যে অফিস হোল্ডার বা একজন জনপ্রতিনিধি বা জনকর্মচারী তার দায়িত্বে অবহেলা করছেন, তখনই জবাবদিহি চাইতে হবে। সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই হতে পারে মাসভিত্তিক অথবা তিন মাসে একবার।
৩. জবাবদিহির মাধ্যমেই পাবলিক অফিস হোল্ডারদের কাজের ফলাফল এবং তাদের যোগ্যতা বিচার করা সম্ভব। জবাবদিহিই তাদের কাজের ফলাফল পরিমাপের উপায়। এমনকি কী কারণে প্রাপ্ত ফলাফল আশানুরূপ হচ্ছে না, তা জেনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তাও দেয়া যেতে পারে।
কোথায় এই জবাবদিহি নেওয়া হবে?
জাতীয় পর্যায়ে নতুন সংস্কার ব্যবস্থায় সংসদের উচ্চকক্ষের সামনে সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিধারী ব্যক্তি যেমন সকল সচিব, অধিদপ্তর প্রধান, বাহিনীপ্রধান, গোয়েন্দা প্রধান, গ্রেড-১ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন।
জেলা পর্যায়ে ডিসি, এসপি, জেলা সদরের সকল সরকারি অফিস হোল্ডার, সিটি ও পৌর মেয়র এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্লাটফর্ম হতে পারে জেলা পরিষদ।
উপজেলা এবং এর নিচে সকল পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং পাবলিক অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এই পর্যায়ে এ সুধীজন বা নাগরিক সমাজের একটি প্যানেল থাকতে পারে, যারা সমাজে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তারা এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও হতে পারেন বা অরাজনৈতিক। তবে এই প্যানেলে যারা থাকবেন, দায়িত্ব পালনকালে তারা যথাসম্ভব নিরপেক্ষ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকার চেষ্টা করবেন। তাদের ব্যক্তিজীবনের আর্থিক সততার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা মাসিক বা প্রতি তিন মাস অন্তর জবাবদিহি না করলেও তারা নির্বাচনের সময় একধরনের জবাবদিহির মধ্যে পড়েন এবং নির্বাচনটি যদি অবাধ-সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত হয়, তাহলে ওই জনপ্রতিনিধিদের দ্বিতীয়বার জয়লাভ করা কঠিন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু পাবলিক সার্ভেন্ট বা জনকর্মচারীদের এ ধরনের কোনো ঝুঁকি নেই। খুব ব্যতিক্রম না হলে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত লোকও সম্মানের সঙ্গে সরকারি চাকরি থেকে বিদায় নিচ্ছেন। অনেকে অবসরে যাওয়ার পরে পুনরায় নানাবিধ সরকারি প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ প্রশাসনিক কোনো ব্যর্থতার দায়ভার তাদের নিতে হয় না। বরং আমৃত্যু তারা একধরনের বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে থাকেন।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শতাধিকবার পেছানোর পরেও তদন্তকারী কর্মকর্তা বা তাদের উপরস্থ দায়িত্বশীলদের না আদালত না সরকার ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছে। কারণ এদের জবাবদিহির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যে কারণে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা ঝুলে আছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা যদি তদন্ত করতে ব্যর্থই হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের বেতন ভাতা হালাল হয় কী করে? জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় রাষ্ট্র কেন এই ব্যর্থ লোকদের পুষবে?
জনগণ ট্যাক্স দেবে। অথচ শহরের অনেক রাস্তা-ঘাট যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের মতো। সময়মতো হাজার হাজার টাকা বিল পরিশোধ করার পরও নাগরিকরা যে বিশুদ্ধ পানি পায় না; গ্যাস পায় না; ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায় না— তার জন্য এ পর্যন্ত কতজনকে জবাবদিহি করতে হয়েছে? কেন একটু বেশি বৃষ্টি হলেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরগুলো ডুবে যায়? শত শত কোটি টাকা খরচের পরও কেন প্রতি বছর একই দৃশ্য দেখতে হয়? যারা ওই সব প্রকল্পের নকশা করেছেন, বাস্তবায়ন করেছেন— তাদের কতজনের জেল হয়েছে?
কেন গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার বিষয়ে কথা বলতে গিয়েও নাগরিকরা সরকারি লোকজনের কাছ থেকে অসম্মানজনক ও অসৌজন্যমূলক আচরণের শিকার হন? তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা কোথায়?
কোন মাপকাঠিতে সরকারি অফিস অধিকারীদের নির্বাচন করা হয়। এই নির্বাচন পদ্ধতিগুলো কেন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না? অর্থাৎ যাদেরকে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব, তারপর সিনিয়র সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে— কী কী মানদণ্ডে এগুলো করা হলো, সেটি জানার অধিকার জনগণের আছে। এই ব্যবস্থাটি থাকলে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘুষ, দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ হতো। যোগ্য ব্যক্তিরাই পদোন্নতি পেতেন। যখন তারা নিজের যোগ্যতায় বড় পদে বসতেন, তখন তাদেরকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের চোখরাঙানি মেনে নিতে হত না। তারা নৈতিকভাবে শক্তিশালী হতেন এবং দায়িত্ব পালনে অনেক গতিশীল হতেন। এটি সম্ভব যদি তারা কেবলমাত্র সাংবিধানিক কাঠামোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন।
মোট কথা, প্রশাসনের সকল স্তরে শুধু যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হলেই প্রশাসনের চিত্র পাল্টে যেত। এজন্য অনেক আধুনিক সিস্টেমও গড়ে উঠেছে। সেসব সিস্টেম অনুসরণ করে সহজেই দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। ‘মেধা না কোটা..মেধা মেধা’— এটি শেষ পর্যন্ত স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে যদি সত্যিই এখানে বিরাট সংস্কার করা সম্ভব না হয়।