Published : 30 Apr 2025, 10:51 AM
দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বিশ্বকে নিজের কলমের খোঁচায় তটস্থ করে ফেলেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর কোনো কোনো উদ্যোগ রীতিমতো ‘গ্লোবাল ফেনোমেননে’ রূপ নিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। তবে, ট্রাম্পের নতুন ধামাকার খপ্পরে এবার পড়েছে শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা।
যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত পরিচিতদের বরাতে খবর পাচ্ছি, নানা টানাপোড়েন চলছে, যেগুলোর অনেক কিছুই আগে থেকে অনুমান করা যায়নি। পূর্বের কোনো নথিসংক্রান্ত ঘাটতির জন্য জরিমানা হলেও, এখনকার ট্রাম্প প্রশাসন রীতিমতো ভিসা বাতিল করে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সাময়িক সময়ের জন্য দেশে ফিরতে আগ্রহী প্রায় সকল অধ্যয়নরতকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো বলছে— যেতে পারেন, কিন্তু ফিরতে পারবেন কি না সেটার ব্যাপারে আমরা কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারব না, সমস্যায় পড়লে সহায়তাও করতে পারব না। ইমিগ্রেশনের বিষয়টি আমাদের হাতে নেই।
ডনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন-বিরোধী নীতি আইনসম্মত উপায়ে গমনকারীদেরও যে বেকাদায় ফেলে দিবে, তা অনুনমেয়ই ছিল।
অন্যদিকে, উচ্চশিক্ষায় বাজেট কমেছে, গবেষণা-বরাদ্দ সংকুচিত হয়ে গেছে, অনেকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকুরি ও গবেষণা কাজের চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে, কনফারেন্স বাতিল হয়ে যাচ্ছে, এমনকি অধ্যয়নরতদের বাহ্যিক কাজের পরিসরও কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিনদেশি দেড় সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর ভিসা কারণ দর্শানো ব্যতীতই বাতিল করা হয়েছে। ঝড়-ঝাঁপটা তাই কম যাচ্ছে না।
মাইক্রো পর্যায়ের সব খবর মিডিয়ায় আসছে না, বাস্তবিক কারণে হয়তো আসা সম্ভবও না। ইতিমধ্যে কলম্বিয়া, জন হপকিন্স, প্রিস্টন, ব্রাউন, কর্নেল ও নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মাত্রায় তহবিল হয় স্থগিত অথবা বাতিল করার খবর পাওয়া গেছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের আইভি লীগের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড ও বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ফেডারেল সরকারের দ্বন্দ্বের খবরে রীতিমতো তোলপাড় পড়ে গেছে।
২.
রাষ্ট্র বলি কিংবা সরকার, তার বিরুদ্ধে ও বিপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাঁড়িয়ে পড়ার নজির বৈশ্বিকভাবে কম নয়। মুখ্যত এই ঘটনাগুলো ঘটে শিক্ষার্থীদের তরফে, তাদের আন্দোলনের মারফত। শিক্ষার্থীরা সরাসরি রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান নানা ইস্যুতে। তবে, এই সংখ্যার তুলনায় নিতান্তই কম হলেও, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মুখোমুখি অবস্থানও কখনও কখনও ইতিহাসে দেখা গেছে। সেজন্য অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানকর্তা তথা উপাচার্যের মেরুদণ্ড সোজা হতে হয়, নইলে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কম শক্ত কাজ না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের এই অবস্থানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনগত জায়গা থেকে বোঝাপড়া করার তাই যথেষ্ট প্রয়োজন আছে।
রাষ্ট্র বনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনার জন্ম হয়েছে কিংবা অদূর ভবিষ্যতেও হবে, সেটিকে হোয়াইট হাউস বনাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বিরোধ হিসেবে দেখাই সঙ্গত হবে। এই বিরোধ এত গভীর পর্যায়ে চলে গেছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরাসরি কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাচীন ও ধনী এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক অ্যালান এম গার্বার।
উদ্ভূত এ পরিস্থিতির পূর্বাপর ও সমগ্র পরিস্থিতি বুঝতে হলে, ফেডারেল সরকারের সাম্প্রতিককালে নেওয়া কয়েকটি উদ্যোগ এবং এগুলোর ঘটনাসূচি ও পারম্পর্য বিষয়ে আমাদের বিশেষ মনোযোগী হওয়া দরকার।
৩.
হার্ভার্ড তথা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে ফেডারেল সরকারের মাথাব্যথা মূলত বিগত কয়েক মাসে বেশ বেড়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি ডনাল্ড ট্রাম্প ‘এন্টিসেমিটিজম রোধে অতিরিক্ত পদক্ষেপ’ শীর্ষক এক নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই আদেশের বলে ৯ ফেব্রুয়ারি বিচার বিভাগ একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেয়। এই টাস্কফোর্সের প্রতিনিধিত্ব করছে ফেডারেল সরকারের সাধারণ সেবা প্রশাসন (জেনারেল সার্ভিস এডমিনিস্ট্রেশন), স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিস) এবং শিক্ষা বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন)।
মূলত ঐ নির্বাহী আদেশ ও টাক্সফোর্স গঠনের মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ফেডারেল সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। এক বিবৃতিতে বিচার বিভাগ বলেছে, ‘টাস্কফোর্সের প্রাথমিক অগ্রাধিকার হলো স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলো থেকে এন্টিসেমিটিক নিপীড়নের মূলোৎপাটন করা।’ সামনে থেকে এই টাস্কফোর্সই কাজগুলো করছে, কিন্তু পেছনে সবকিছুই হচ্ছে আসলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কলমের খোঁচায়।
এই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই, গত ফেব্রুয়ারিতে আইভি লীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেডারেল তহবিলের ৪০০ মিলিয়ন ডলার স্থগিত করার ঘোষণা দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। বস্তুত ‘জিউস শিক্ষার্থীদের এন্টিসেমিটিক নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায়’ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় প্রশাসন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৪ সালের এপ্রিলে সংঘঠিত ইসরাইলবিরোধী প্রতিবাদের এপিসেন্টারে পরিণত হয়েছিল, যেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই এই প্রতিবাদ পুরো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
গত ১৩ মার্চ টাস্কফোর্স কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রেরিত চিঠিতে ৯টি শর্ত দিয়ে জানায় যে, এগুলো মেনে নিলে তাদের স্থগিতকৃত ফেডারেল তহবিলের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে। ১৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেল সরকারের শর্ত মেনে নিয়মকানুনের পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি জানায়। অবশ্য, শর্ত মানলেও ফেডারেল সরকার এখনও তহবিল ফেরত দেয়নি। আবার দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানায়নি।
৪.
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নাজেহাল পরিস্থিতি যখন চলছিল, তখন থেকেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনকে সতর্ক করে রাষ্ট্রীয় খড়গ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে আসার আগেই প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় প্রকাশ্যে অবস্থান নিতে আহবান জানান। কেননা, যে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার বিভাগ তদন্তের জন্য তালিকাভুক্ত করে, তার মধ্যে হার্ভার্ডেরও নাম আছে।
এই অধ্যাপকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম অধ্যাপক রায়ন ইনোস ও অধ্যাপক স্টিভেন লেভিতস্কি। হার্ভাড-শিক্ষার্থীদের সংবাদপত্র ‘দৈনিক হার্ভার্ড ক্রিমসন’ পত্রিকায় তাঁরা দুই দফা উপসম্পাদকীয় লেখেন। ৬ মার্চ ‘গণতন্ত্রের পক্ষে হার্ভার্ডকে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে’ শিরোনামে লেখা উপসম্পাদকীয়তে তাঁরা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিশ্চুপ থাকার সমালোচনা করেন। এর পর, ১৪ মার্চ তাঁরা ‘প্রথমে তারা এসেছিল কলম্বিয়ার উদ্দেশে’ (ফার্স্ট দে কেইম ফর কলম্বিয়া) শিরোনামে আরেকটি লেখা লিখেন। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়েমুলারের ১৯৪৬ সালে লেখা বিখ্যাত ‘ফার্স্ট দে কেইম’ কবিতার অনুকরণে এই শিরোনামটি করেন ঐ দুই অধ্যাপক।
এই লেখাতেও তাঁরা সরকারি পদক্ষেপ ও হস্তক্ষেপ বিষয়ে আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীরব থাকার সমালোচনা করেন এবং এ ব্যাপারে হার্ভার্ডের প্রকাশ্যে কথা বলার গুরুত্ব তুলে ধরে লেখেন, ‘হার্ভাডকে অবশ্যই ঋজু হতে হবে, কথা বলতে হবে এবং বাকস্বাধীনতা ও মুক্তশিক্ষার পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিতে হবে।’ কেননা, এরপরে একে একে সব ধ্বংস করে ফেলা হলে, কথা বলার জন্য আর কাউকেই পাওয়া যাবে না।
অধ্যাপক ইনোস ও লেভিতস্কির আশঙ্কা ভ্রান্ত হয়নি। গত ৩১ মার্চ সাধারণ সেবা প্রশাসনের কমিশনার টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ক্যাম্পাস পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার হার্ভার্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ৯ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল তহবিল বিষয়ে পর্যালোচনার করবে। ঐ চিঠি থেকেই জানা যায়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে টাস্কফোর্সের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহ পোষণ করে।
এরপর, ৩ এপ্রিল টাস্কফোর্সের তিন বিভাগের প্রতিনিধিদের স্বাক্ষরিত দুই পৃষ্ঠার আরেকটি চিঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্বার ও হার্ভার্ড কর্পোরেশনের মুখ্য সদস্য পেনি প্রিৎজকার বরাবর প্রেরণা করা হয়। এ চিঠিতে টাস্কফোর্স আলোচনার জন্য ৯টি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব করে। আশঙ্কাজনকভাবে এগুলোর অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কড়া হুঁশিয়ারি ও তার স্বাধীনতার পক্ষে হুমকিস্বরূপ।
এই চিঠির জবাব না পাওয়ায় টাস্কফোর্স ১১ এপ্রিল পূর্বতন বিষয়গুলোকে আরও বিস্তৃত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর পাঁচ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে। এতে ১০টি দাবি উত্থাপন করে আরও কড়া ভাষায় হার্ভার্ড প্রশাসন ও তার ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করা হয়, মোটাদাগে যার মূল বিষয় ছিল হার্ভার্ড ক্যাম্পাসে জিউসবিরোধী ক্যাম্পেইন ও প্রতিরোধ বিষয়ে হার্ভার্ড প্রশাসনের নীরব ভূমিকা। মূলত এই চিঠির পরই পরস্থিতি ঘোলাটে হতে শুরু করে।
৫.
চলমান এ লড়াইয়ে স্বভাবতই হার্ভার্ডের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক অ্যালান এম গার্বার। টাস্কফোর্স চিঠি দেওয়ার তিনদিন পর, ১৪ এপ্রিল হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট ফেডারেল সরকারের নীতির কঠোর সমালোচনা করেন এবং সরকারের প্রস্তাবিত চুক্তিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে হার্ভার্ড কমিউনিটির উদ্দেশ্যে ‘আমেরিকান উচ্চশিক্ষার অঙ্গীকার’ শিরোনামে এক প্রকাশ্য চিঠি লিখেন। ঐ দিনই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে দু’জন আইনি পরামর্শক প্রায় একইরকম বক্তব্য হাজির করে ফেডারেল সরকারের টাস্কফোর্সের চিঠির আনুষ্ঠানিক জবাব দেন।
লক্ষ্যণীয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয় যে ফেডারেল সরকারের কাছে নতি স্বীকার করবে না, এই পদক্ষেপের মধ্যে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সরকারি সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট বরাবর চিঠি দিলেও, তিনি চিঠির আনুষ্ঠানিক জবাব দেননি। বরং উত্তর করিয়েছেন আইনি পরামর্শক দ্বারা— এই ‘সাহস’ সবাই করতে পারেন না। হোয়াইট হাউজ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চাপান-উতর চরমে চলে যায় মুখ্যত গার্বারের এই চিঠির পরপরই।
উল্লেখ্য যে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই রাষ্ট্র বনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াইয়ে হার্ভার্ড প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্বার সরাসরি সরকারি কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার পথে যাননি শুরুর দিকে। এমনকি তিনি ফেডারেল সরকারের টাস্কফোর্সের সঙ্গে বসতেও চেয়েছিলেন। আবার, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাও করছিলেন পরিস্থিতি বোঝার জন্য। তবে, নিশ্চিতভাবেই হয়তো তিনি অন্তর্হিত চাপ অনুভব করছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ওপর সরকারি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে হার্ভার্ড প্রশাসনের দীর্ঘদিন নিশ্চুপ থাকা এবং প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে অবস্থান না নেওয়ায় শিক্ষকরা সমালোচনামুখর ছিলেন। আটশতাধিক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে এক চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। কেউ কেউ খোদ ‘দৈনিক হার্ভার্ড ক্রিমসনে’ লেখা উপসম্পাদকীয়তে বলেন, পদক্ষেপ নিতে না পারলে অ্যালান গার্বারকে পদত্যাগ করতে হবে। সহস্রাধিক প্রাক্তনের স্বাক্ষরিত দুইটি স্বতন্ত্র চিঠি হার্ভার্ড প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। কিন্তু, গার্বার প্রকাশ্যে ওই চিঠিটি লেখার পরপরই তিনি বহু শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রাক্তন ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি সমর্থন পেয়েছেন।
আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা সংক্রান্ত গবেষণায় নিশ্চিতভাবেই গার্বারের এই চিঠি গুরুত্বপূর্ণ এক রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মানবজাতির উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা, চিন্তার স্বাধীনতা ও সরকারি প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গার্বার ফেডারেল সরকারের ওই কর্তৃত্ববাদী অবস্থানের বিপক্ষে গিয়ে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমরা প্রশাসনকে আমাদের আইনি পরামর্শকের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি, আমরা তাদের প্রস্তাবিত চুক্তি মানব না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাধীনতা সমর্পণ করবে না কিংবা সাংবিধানিক অধিকার বিসর্জন দিবে না।’
৬.
হার্ভার্ড সরকারি প্রশাসনের দাবিসমূহ নাকচ করে নিজেদের জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করার অব্যবহৃত পরেই ফেডারেল সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টির ৯ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল চুক্তি ও অনুদানের মধ্য থেকে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল তহবিল স্থগিত করে। পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়টির করছাড় সুবিধা ও আন্তজার্তিক শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া স্থগিত করারও হুমকি প্রদান করে।
এরপরে, ১৮ এপ্রিল মঞ্চে আবির্ভূত হয় দেশীয় নিরাপত্তা বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি)। তারা হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছে বিদেশি শিক্ষার্থীদের যাবতীয় তথ্য চেয়েছে। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দোষারোপ করে বলেছে যে, প্রতিষ্ঠানটি জিউসবিরোধী ভূমিকা পালন করছে যা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-আদর্শ পরিপন্থী। শিক্ষার্থীদের ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থানকে তারা ‘বেআইনি ও বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সরকার ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। অন্যথায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা তো বাতিল হবেই, সঙ্গে ‘স্টুডেন্ড এন্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর প্রোগ্রামে’র (এসইভিপি) সনদও হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়ে ফেলবে বলেও চিঠিতে কঠিনভাবে বার্তা দেওয়া হয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য ওই ১৮ এপ্রিলই প্রতিষ্ঠানটির ফেডারেল তহবিল স্থগিতের বিরুদ্ধে ফেডারেল আদালতে মামলা করেছে। হার্ভার্ডের এই সরকারি নীতিবিরোধী অবস্থান বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চালানো রাষ্ট্রীয় খবরদারির বিরুদ্ধে হওয়া প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ।
হার্ভার্ডের এমন অনড় অবস্থানের পর, খোদ হোয়াইট হাউস থেকেই কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, ১১ এপ্রিল প্রেরিত চিঠিটির কোনো সরকারি ভিত্তি আছে কি না কিংবা আদৌ চিঠিটি সঠিকপন্থায় পাঠানো হয়েছে কি না? নাকি ‘ভুলবশত’ চলে গিয়েছে হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষের কাছে? যদিও চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন বলেছেন, চিঠিটি আগে হোক বা পরে, হার্ভার্ডকে পাঠানো হতোই।
হোয়াইট হাউসের ভেতর থেকেই উঠে আসা এমন দ্বিধান্বিত বক্তব্য বলে দেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় যদি চায় তাহলে রাষ্ট্র বা সরকার যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাকে নাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। আর এ তো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬২ জন নোবেল বিজয়ীর জন্মদাত্রী, প্রবল প্রতাপশালীর খড়গের কাছে সে নতি স্বীকার করবে কেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তশিক্ষার পক্ষে তার না দাঁড়ালে চলবে কেন!
৭.
এই সমস্যার সমাধান কী হবে, তা দেখার জন্য বাংলাদেশের মতো সারাবিশ্বই উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে। কেননা এর সঙ্গে বহু মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ভবিষ্যতের জীবন ও জীবিকার সম্পর্ক আছে। সমস্যা হলো, হার্ভার্ড যদি এই লড়াইয়ে জেতেও, বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার দেওয়া না-দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার ফেডারেল সরকারের। বিশ্বব্যাপী তাদের দূতাবাসগুলো কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই ভিসা বাতিল করে দেওয়া এখতিয়ার রাখে, তা যতই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির ক্ষেত্রে যথাযথ নথিপত্র শিক্ষার্থীদের দিক না কেন। এমনটা হলে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা আছে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নের স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীদের।
আশার কথাও অবশ্য আছে। কোথাও পথ সংকুচিত হয়ে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে, নিশ্চয়ই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য অন্য পথ খুঁজে নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যই এই নীতি অবলম্বন করে, তাহলে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অভিবাসননীতি সহজ করে ফেলতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত সদস্য এবং কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো। এমনকি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ, যেমন, চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুর, যাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক স্তরে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে।
ধারণা করি, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে কানাডা। ট্রাম্প আসার পর তিনি কানাডার বিরুদ্ধেও নানামাত্রিক ‘অ্যাকশন’ নিয়েছেন। কানাডা শিক্ষাক্ষেত্রে বৈশ্বিক দ্বার উন্মুক্ত করে সেসবের ‘মধুর প্রতিশোধ’ নিতে চাইলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কানাডা বরাবরই অভিবাসীবান্ধব দেশ। মাঝে লিবারেল পার্টির নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল সরকারিনীতি কানাডায় অভিবাসীদের ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং অনেকেই বিবিধ জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন।
তবে, দেশটির ৪৫তম সংসদ নির্বাচনের পর যে ফেডারেল সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারকে পুর্ণোদ্দমে নেতৃত্ব দেবেন কট্টোর ট্রাম্পবিরোধী লিবারেল পার্টির নেতা ও গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী হওয়া মার্ক কার্নি। নতুন এই সরকার যদি সত্যিকার অর্থেই অভিবাসীবান্ধব হয়ে উঠতে সচেষ্ট হয় কিংবা শুধু ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান থেকেও অভিবাসন প্রশ্নে বর্তমান নীতিকৌশল বদলে ফেলতে চায়, তাহলে হয়তো উত্তর আমেরিকার শিক্ষাদ্বার আবারও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে গ্লোবাল সাউথের শিক্ষার্থীদের জন্য।
গ্লোবাল নর্থের উচ্চশিক্ষা, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার, গ্লোবাল সাউথের জন্য বহু যুগ ধরেই এক পাথেয় বটে। উত্তরের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের রাজকৌশল আশঙ্কা তৈরি করেছে ঠিক, বাকিরা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই অভিবাসনের সম্ভাবনা উঁচুতে নিয়ে যাবে বলেই আশা করা যায়।