এটা হাস্যকর আবার একই সঙ্গে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনাও। মানুষ তখন ভয়ঙ্কর দুর্নীতিগ্রস্ত। এমনকি এ ধরনের প্রহসনের জীবনে বিরোধীরাও জড়িত থাকত। কেবল ত্রুহিয়্যোর একনায়কত্ব নয়, সব একনায়কত্বের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হচ্ছে আত্মিক দুর্নীতি- এটাও একনায়কত্বের ফল।
Published : 17 Apr 2025, 10:11 PM
মারিয়ো বার্গাস ইয়োসাকে নিয়ে যে লেখাটি দাঁড় করাচ্ছি তার অনেকটাই অনুবাদ। রাজু আলাউদ্দিন মারিয়োকে নিয়ে একটি বর্ণিল, তথ্যসমৃদ্ধ এবং সুখপাঠ্য একটি গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। আমি গার্সিয়া মার্কেজ ও মারিয়োকে নিয়ে পরিচিতিমূলক একটি বই প্রকাশ করেছি। সুতরাং মারিয়ো বার্গাস ইয়োসার প্রয়াণে একটি অবিচুয়ারি লেখার দায় আমাদের উপর বর্তাতেই পারে।
শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আমি বেছে নিই মারিয়োর কিছু সাক্ষাৎকার এবং একটি ভাষণের অনূদিত অংশ বিশেষ।
নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিই ফ্রেঞ্চ একাডেমির সদস্যপদ লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। একাডেমির সদস্য সর্বোচ্চ চল্লিশজন, কিছু চেয়ার বরাবারই খালি থেকে যায়। ১৯৫২ সাথে ফ্রাঁসোয়া মরিয়াক নোবেল পুরস্কার পাবার পর বহু বছর কেটে গেছে, ১৯৬৪-তে সাহিত্যে নোবেল জয়ী জ্যঁ পল সার্ত্র নোবেল প্রত্যাখান করেছিলেন, ২০২৩-এ পরবর্তী গৃহীত সদস্য মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা ২০১০-এর নোবেল লরিয়েট। একাডেমির খ্যাতিমান সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ভলতেয়ার, ভিক্টর হুগো, আলেকজান্ডার দুমা, জ্যঁ পল সার্ত্র ; বিজ্ঞানীদের মধ্যে লুই পাস্তর, বিদেশি কবি ও রাষ্ট্রপ্রধান লিওপোল্ড সেদর সেংঘর; প্রচলিত আছে ফ্রেঞ্চ একাডেমির সদস্যপদপ্রাপ্তি অমরত্ব প্রদান করে। ২০২৩-এ অমরত্বের সনদ পেলেন মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ স্পেনের জাঁদরেল পত্রিকা `এল পাইস'-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো যে তিনি অমর -“the immortal.”
তিনি বললেন, “অমরত্ব ব্যাপারটা খুব একঘেয়ে হবে। কাল বাঁচতে হবে, পরশু বাাঁচতে হবে, তারপর শুরু হবে অনন্তকাল... তার চেয়ে বরং মরে যাওয়া ভালো। তবে যতোটা সম্ভব দেরিতে, তবু মরতেই হবে।”
আপনি কি মরনোত্তর কালের কথা ভাবেন? মরনোত্তর খ্যাতি?
জীবনে কখনো ভাবিনি। আমার সন্তান, তাদের সন্তানদের কথা ভেবেছি; কিন্তু আমার বই নিয়ে কখনো ভাবিনি।
আপনি কখনো ভাবেন নি-“আমার এই বইটা চিরদিন টিকে থাকবে কিংবা আমার সেই বইটা”?
হ্যাঁ, কিছু বই আমার মৃত্যুর পর আমাকে ছাড়িয়ে কিছুকাল টিকে থাকবে- কনভার্সেশন ইন দ্য ক্যাথিড্রাল, দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এই দুই বই আমি খুব পরিশ্রম করে লিখেছি। নিজের মৃত্যু নিয়ে কিছু ভাবি না। আমি মরে গেলে আমার কাজগুলোর কী হবে? আমার কোনো ধারণা নেই, আমি এসব নিয়ে ভাবিও না।
তাহলে কি নিয়ে ভাবেন?
এসব কিছু নিয়ে মোটেও নয়। মানুষের ক্রমাবনতি ও ক্ষয়ে যাওয়া, ধ্বংস হওয়া আমার ভীষণ অপছন্দের। এর চেয়ে খারাপ কিছু আমার বেলায় ঘটতে পারেনা। এখন আমার স্মৃতি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, আমার বরাবরই চমৎকারভাবে স্মৃতি ধারণ করে রাখতে পেরেছে। আমি সব কিছু স্মরণ রাখতে পারতাম, সেই স্মরণ ক্ষমতা কমে আসছে, আমি বেশ অনুভব করছি। এটাই অবশ্যম্ভাবী। আমার বয়স এখন ৮৬ বছর (৩ বছর আগের বক্তব্য)। অনেক কিছু আমি অন্যদের চেয়ে বেশি মনে রাখছি, কিন্তু কিছু নাম--দুর্ভাগ্যবশত ভুলে যাচ্ছি; চেহারাটা ভাসছে, নামটা মনে পড়ছে না।
আপনি কি স্মৃতিতাড়িত?
কিছুটা তো বটেই। আমার স্মৃতিতে জেগে থাকা অনেক কিছুই এখন আর নেই, সেসবের জন্য আফসোস হয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা স্পষ্টভাবে মনে পড়ে, কিন্তু তার পরপর যে জীবন, তা কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে; আমার স্মৃতি মেঘের মতো, কখনো খুব বিষন্ন, কখনো আনন্দসমৃদ্ধ। বলিভিয়াতে আমার অবস্থানকালে ব্রাদার জাস্টিনিয়ানোর কথা, তিনি আমাদের পড়তে শিখিয়েছেন। খাটো দেহের এই ইতালিয় মানুষটি আমাদের নাচতে শিখিয়েছেন, অক্ষর চিনিয়েছেন, আমাদের সংযুক্ত করেছেন, সে বিস্ময়কর সময় আমার জীবনের শ্রেষ্ট সময় হিসেবে এসেছে।
আমার জীবন গড়ার ভিত্তিমূলে বইপড়া।
বইপড়া আমার সব বদলে দিল। কোচাবাম্বার মতো ছোটো শহর নয়, বই আমাকে নিয়ে গেল এক বিশ্বে, যার শুরু নেই শেষ নেই, অনন্তে। আমি সফর করতে পারছি, সময় সফরও চলছে-ভবিষ্যতে ও অতীতে। বই মানে বরাবরই অভিযান। মায়ের বেডসাইড টেবিলে যে সব বই তা পাঠ আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে একটি বই হলদে রঙের, নীল হরফে লেখা: পাবলো নেরুদা-কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান। বইয়ের শুরুর দিকে কয়েকটি পংক্তি আমার মনে আছে: আমার খসখসে চাষার দেহ খনন করে তোমার অভ্যন্তরে ঢুকে যায়, এবং পৃথিবীর গভীর থেকে পুত্রসন্তান লাফিয়ে নেমে আসে’। আমি ভাবলাম এটা নিশ্চয়ই পাপকর্ম। কিন্তু পাপ কী? পাপ কী আমি জানি না, কিন্তু ব্যাপারটাতে কোথাও পাপ রয়েছে, আমি জানতে পেরেছি।
মঞ্চে এসেছেন ইয়োসা : এক হাজার এক রাত্রির গল্পে তাঁর সাথে অভিনেত্রী সাবা
২.
মারিয়োর জন্মের অল্পদিন আগে বাবা এর্নেস্তো আর মা ডোরার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এর্নেস্তো ডোরাকে তালাবন্ধ করে রাখতেন আর নিজে উপভোগ করতেন দয়িতার সঙ্গ; তারাও তার সন্তানের জন্ম দেয়। দশ বছর বয়স পর্যন্ত মারিও জানতেন তার বাবা মৃত। সে সময় এর্নেস্তো ও ডোরার আবার মিলন হয়।
“বাবার সাথে সম্পর্কটার সূচনা বড্ডো বাজেভাবে। আমি আবিষ্কার করলাম বাবা মৃত নন। আমাদের মধ্যে কখনো কোনো সমঝোতা হয়নি, কেবলই সার্বক্ষণিক বিরোধ ও উত্তেজনা। কেউ বলতে পারেন এটা আমারই দোষ, কিন্তু তিনি আমার মাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন, কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু করেছেন। তিনি কঠোর একরোখা মানুষ ছিলেন। তার কর্তৃত্ব প্রতিরোধ করতেই আমি পন্থা হিসেবে সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ি।”
ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, সাহিত্য সমালোচক এবং সাংবাদিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা নিজেকে স্বৈরাচার, নৈরাজ্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। কর্মজীবনের শুরুতে নেওয়া সামরিক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা এবং সমরচর্চার অসারতা নিয়ে রচনা করেন তার প্রথম উপন্যাস দ্যা টাইম অব দ্য হিরো। উপন্যাসে জেনারেলদের হাস্যকর ও ফাঁপা চরিত্রের নিপুণ চিত্রায়ন দ্রুত তাকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করলেও সমরনেতাদের শত্রুতে পরিণত হন ইয়োসা। দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য গ্রিনহাউস-এ উন্মোচন করেন ধর্মীয় ভন্ডামির মুখোশ। পেরুর স্বৈরশাসন ও ধর্মীয় অনাচার নিয়ে রচনা করেন উপন্যাস কনভার্সেসন ইন দ্য ক্যাথিড্রাল।
১৯৭১ সালে কলম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গার্সিয়া মার্কেজের সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণায় স্পেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অর্জন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে এই দুই ক্ষমতাধর লেখকের সম্পর্কের অবনতিও ঘটে। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত উপন্যাস দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড-- পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার যুদ্ধ তার রচনাশৈলীতে ভিন্ন একটি মাত্রা যোগ করে। সাহিত্যের সঙ্গে সমঝোতা না করে ইতিহাসকে নতুনভাবে বুনেন তিনি এই উপন্যাসে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত দ্য ব্যাড গার্ল চিহ্নিত হয়েছে নতুন সহস্রাব্দের মাদাম বোভারি হিসেবে।
তিনি সৃজনশীলতার প্রশ্নে কখনও থেমে থাকেননি। প্রবন্ধে, নিবন্ধে, বক্তৃতায় নাটকে অবিরাম সৃষ্টিশীল রয়েছেন। তার হাতেই লাতিন সাহিত্যের আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার নতুন রূপায়ণ ঘটেছে।
২০১০-এ নোবেল সাইটেশনে উল্লেখ করা হয় : ক্ষমতা কাঠামোর নিখুঁত মানচিত্রকর্ম এবং ব্যক্তির প্রতিরোধ, বিদ্রোহ ও পরাভবের মর্মভেদী চিত্রকল্প নির্মাণের জন্য এই বরেণ্য সাহিত্যিককে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।
ল্যাটিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের অন্যতম চতুষ্টয় হোর্হে লুইস বোর্হেস, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস এবং মারিও বার্গাস ইয়োসার হাতে সাহিত্যে যে ‘ল্যাটিন আমেরিকান বুম’ সৃষ্টি হয়েছে, তার ঢেউ আমাদেরও স্পর্শ করেছে।
সমকালীন লেখকদের মধ্যে যাদের লেখা পড়েন, কাকে বিশেষভাবে পছন্দ?
প্যারিস রিভিওর স্মরণীয় সাক্ষাৎকারে মারিও বার্গাস ইয়োসা বলেন: “যখন তরুণ ছিলাম, আমি সার্ত্রের প্রবল ভক্ত-পাঠক ছিলাম। আমেরিকান ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিশেষ করে হৃত প্রজন্মের (লস্ট জেনারেশন) ফকনার, হেমিংওয়ে, ফিটজেরাল্ড, ডস প্যাসোস পড়েছি-- এদের মধ্যে বিশেষভাবে ফকনার। আমার তরুণ বয়সে পাঠ করা লেখকদের মধ্যে যে অল্প ক’জন আমার কাছে এখনও গুরুত্বপূর্ণ, ফকনার তাদের একজন। পুনরায় ফকনার পড়তে গিয়ে আমি কখনও হতাশ হইনি। যেমনটা কখনও কখনও হেমিংওয়ে পড়তে গিয়ে হয়েছে। এখন আমি আর সার্ত্রে পড়ব না।
তখন থেকে আমি যেসব পড়েছি তার সাথে তুলনা করলে তাঁর উপন্যাসগুলো মনে হয় পুরনো ধাঁচের, এবং এরই মধ্যে এর মূল্যও অনেক কমে গেছে। আর তাঁর প্রবন্ধের অধিকাংশের গুরুত্ব কম, ব্যতিক্রম একটি সন্ত জেনে : কৌতুককার না শহীদ, আমার এখনও পছন্দ। এগুলো স্ববিরোধিতা, অস্বচ্ছতা, অযথার্থতা ও অসংলগ্নতায় পরিপূর্ণ যা কখনও ফকনারের বেলায় ঘটেনি।
ফকনারই প্রথম উপন্যাসিক, কাগজকলম হাতে নিয়ে আমি যার লেখা পড়েছি কারণ তাঁর লিখনশৈলী আমাকে অভিভূত করেছে। ফকনারই প্রথম ঔপন্যাসিক যার রচনা অনুসরণ করে আমি তা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছি-- যেমন সময়ের বিন্যাস, কাল ও স্থানের মিলন এবং বৃত্তান্তের বিভাজন; এবং কাহিনীতে বাড়তি গভীরতা যোগ করতে সুনির্দিষ্ট অস্পষ্টতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে তাঁর গল্প বয়নের যে ক্ষমতা তাও অনুসরণ করেছি।
ল্যাটিন আমেরিকান হিসেবে তাঁর বইগুলো পড়া আমার জন্য খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল-- যখন আমি লিখতে যাই এগুলো আমার জন্য বর্ণনা কৌশলের একটি মহার্ঘ উৎস হিসেবে কাজ করেছে, কারণ আমার বেলায় তা এমন একটি ভুবনে প্রযুক্ত যা ফকনারের ভুবন থেকে তেমন ভিন্নতর নয়। পরে আমি অবশ্যই গোগ্রাসি আবেগে উনিশ শতকের ঔপন্যাসিক ফ্লবেয়র বালজাক, দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়, স্তাঁদাল, হথর্ন, ডিকেন্স ও মেলভিল পড়েছি। আমি এখন উনিশ শতকের লেখকদের উৎসাহী পাঠক।
ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যের কথা যদি বলতে হয়, অবাক ব্যাপারই বলতে হবে, ইউরোপে এসে বসবাস শুরু না করা পর্যন্ত আমি তাদের আবিষ্কার করতে পারিনি। তখনই প্রবন্ধ উৎসাহ নিয়ে পড়তে শুরু করি। আমাকে লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হতো, আর তা ছিল নিজেকে সমৃদ্ধকরণের অভিজ্ঞতা, কারণ তা আমাকে সামগ্রিকভাবে ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে। তখন থেকে আমার বোর্হেস পাঠ শুরু যার সাথে আমি আগে কিছুটা পরিচিত ছিলাম। সে সাথে শুরু করি কার্পেন্তিয়ের, কোর্তাসার, গুইমারেস রোসা, লেসামা লিমা, গার্সিয়া মার্কেস ছাড়া গোটা প্রজন্ম।
আমি তাঁকে পরে আবিষ্কার করি এবং এমনকি তাকে নিয়ে একটি বই লিখি গার্সিয়া মার্কেস: হিস্ট্রি অব ডিইসাইড (গার্সিয়া মার্কেজ : দেবহত্যার ইতিহাস)। আমি উনিশ শতকের ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যও পড়তে শুরু করি, কারণ আমাকে তা পড়াতে হতো। আমি বুঝতে পারলাম আমাদের অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী কিছু লেখক রয়েছেন-- এদিক দিয়ে ঔপন্যাসিকরা প্রবন্ধকার ও কবিদের চেয়ে কম হৃদয়গ্রাহী। যেমন সারমিয়েন্তো কখনও একটি উপন্যাসও লিখেননি, কিন্তু আমার বিবেচনায় ল্যাটিন আমেরিকার গল্পকারদের মধ্যে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ; তাঁর ‘ফাকুন্দো’ একটি মহৎকর্ম।
কিন্তু আমাকে কেবল যদি একটি নাম বেছে নিতে বাধ্য করা হয় আমাকে বোর্হেসের কথা বলতে হবে, কারণ যে ভুবন তিনি সৃষ্টি করেছেন, আমার মনে হয় তা সম্পূর্ণ মৌলিক। বিপুল মৌলিকত্ব এক পাশে রাখলেও তিনি যে বিশাল কল্পজগত ও সংস্কৃতির অধিকারী হয়েছেন তা স্পষ্টতই তাঁর নিজস্ব। আর অবশ্যই বোর্হেসের ভাষা তো রয়েছেই, যা আমাদের ঐতিহ্য ভেঙ্গে নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করেছে।
স্পেনিশ ভাষার প্রবণতা প্রাণোচ্ছলতা, দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও অতিরঞ্জনের দিকে। সের্বান্তেস থেকে অর্তেগা ই গাসেত, বাইয়ে ইনক্লান এবং অলফনসো রেইয়েস- আমাদের সকল প্রধান লেখকই বাক বিস্তারে অভ্যস্ত। বোর্হেস তাদের উল্টো--সংক্ষিপ্ত, মিতকথন এবং যথাযথ। স্প্যানিশ ভাষার একমাত্র লেখক তিনিই যিনি যত শব্দের অধিকারী তত ধারণারও। আমাদের কালের মহান লেখকদের একজন তিনি।
নোবেল ভাষণ থেকে:
আমরা যেসব ভালো বই পড়ছি, যেগুলো না থাকলে আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হতো, আরো গতানুগতিক, চাঞ্চল্যহীন, আরো সমর্পিত আর সংকটাকীর্ণ হয়ে পড়ত, প্রগতির ইঞ্জিনের অস্তিত্বই থাকত না।
লেখালেখির মতো পড়াও জীবনে অপর্যাপ্ততার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। জীবনে যা মেলে না তার জন্য কাহিনীতে ডুবে যাই, আমরা বলতে থাকি-- যদিও বলা কিংবা জানার দরকার নেই-- জীবন যেমনটি আছে ঠিক সেভাবে আমাদের তৃষ্ণা মেটাতে পারে না। মানুষের জীবনমানের ভিত্তি তো আরো উন্নততর হতে হবে। আমাদের হাতে যখন কেবল একটাই জীবন, আমরা তার জন্য গল্প আবিষ্কার করি, যাতে তার মধ্যে আমাদের ইচ্ছামতো যেকোনোভাবে যে জীবন লালন করতে চাই, যেন সে রকম বহু জীবন যাপন করতে থাকি।
গল্প ও কাহিনী ছাড়া স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে জীবন আমাদের অনেক কম সচেতন রাখত-- যখন কোনো স্বৈরাচার, কোনো ভাবধারা কিংবা কোনো ধর্মের পদতলে জীবন পিষ্ট হয়, জীবন তখন নারকীয় হয়ে ওঠে। সাহিত্য আমাদের কোনো সুন্দর ও সুখের স্বপ্নে ডুবিয়ে রাখে না, সব ধরনের অনাচার সম্পর্কে সচেতন করে-- যাঁরা এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করুন-- সকল শাসনামলেই কোল থেকে কবর পর্যন্ত নাগরিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে কেন মরিয়া হয়ে ওঠে, কেন স্বাধীন লেখকের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখে।
তারা তাই করে, কারণ তারা জানে বইয়ের ভেতর চিন্তাকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দিলে ঝুঁকি কোথায়, তারা জানে কাহিনী কতটা রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে, যখন তারা কতটা স্বাধীনতা প্রাপ্য কল্পনা করে এবং বাস্তব পৃথিবীতে বাধা ও ভীতি সঞ্চার করে তাদের ওপর কী প্রয়োগ করা হয় তা বিবেচনায় আনে।
লেখকরা চান কিংবা নাই চান, তাঁরা জানেন কিংবা না-ই জানেন, তাঁরা যখন গল্প আবিষ্কার করেন, গল্পে তাঁরা অসন্তোষ ছড়াতে থাকেন, দেখিয়ে দেন তাঁদের পৃথিবীটা কত বাজেভাবে নির্মিত এবং কল্পনার জীবনটা আমাদের নিত্যকার জীবনের চেয়ে কত সমৃদ্ধ। এই সত্য যখন তাঁদের সংবেদন ও সচেতনতায় প্রোথিত হয়, নাগরিকদের সুবিধামতো ব্যবহার করা কঠিন হয়ে ওঠে, তদন্তকারী ও কারাকর্তার মিথ্যেগুলোকে গ্রহণ করতে কম ইচ্ছুক হয়, যখন তারা তাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, গারদের ভেতরই নাগরিকরা অধিক নিরাপদ ও উন্নততর জীবন খুঁজে পাবে। ...
সাহিত্যকে ধন্যবাদ, কোনো কিছুই আমাদের উদ্বিগ্ন করেনি, আমাদের কল্পশক্তি ও জীবনতৃষ্ণাকে বাধাগ্রস্ত করেনি, আমাদের সাহিত্য বড় অভিযান আমাদের অগ্রনায়ক করে তুলেছে, বাস্তবজীবন এই আবেগ কখনো দিতে পারবে না।
সাহিত্যের মিথ্যা কাহিনী আমাদের মধ্য দিয়ে সত্যে পরিণত হয়, পাঠকের রূপান্তর ঘটে, বাসনার ছোঁয়াচে প্রভাবে, কাহিনীর গরমিলের মধ্যে দিয়ে সাধারণ বাস্তবতাকে স্থায়ীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আমাদের যা নেই তা থাকার অনুভূতি সাহিত্যের যে জাদু আমাদের দেয়, সেই অসম্ভব অস্তিত্বে সম্মতি জাগায়, যেখানে প্যাগান ঈশ্বরের মতো আমাদের মধ্যে একই সঙ্গে মরণশীলতা ও অমরত্বের বোধ সৃষ্টি করে, যা আমাদের আত্মসত্তায় আচার-বিরুদ্ধতা ও বিদ্রোহের সূচনা করে যা রয়ে গেছে সব বীরত্বপূর্ণ কর্মকান্ডের পেছনে, যা মানবিক সম্পর্কে সহিংসতা লাঘবে অবদান রেখেছে। সহিংসতা হ্রাস করেছে, সহিংসতার অবসান ঘটায়নি।
কারণ সৌভাগ্যবশত আমাদের গল্পটা সব সময়ের জন্যই একটি অসমাপ্ত গল্প। সে কারণেই আমাদের স্বপ্ন দেখা, বই পড়া, লেখা অব্যাহত রাখতে হবে আর এটাই আমাদের নশ্বর অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে, সময়ের ক্ষয় পরাভূত করবে এবং অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করবে।
মারিও বার্গাস ইয়োসা এবং ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ
৪.
যে কোনো ধরনের একনায়কত্বের একটি হতাশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে এটি নিয়ে পরীক্ষার সময়, গবেষণার সময়, তদন্তের সময় দেখা যায় বহুসংখ্যক দুষ্কর্মের সহযোগীর সহযোগিতা না পেলে একনায়ক হয়ে ওঠা সম্ভব হতো না। এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই নয়, সবগুলোতেই একনায়ক একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের বৃহদংশের সমর্থন পেয়ে থাকে। সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য তারা তাদের অধিকার সেই বৃহৎ একনায়কের কাছে হস্তান্তর করে। এভাবে নিজের অধিকার ছেড়ে না দিলে ত্রুহিয়্যো কিংবা ইতিহাসের ভয়াবহ একনায়কদের অভ্যুদয় ঘটা অসম্ভব হয়ে উঠত।
রোমানা : কিন্তু যে সব মানুষ ত্রুহিয়্যোকে সমর্থন জুগিয়েছে, একনায়ক ত্রুহিয়্যো তো তাদেরই অপদস্থ করেছে।
মারিও : হ্যাঁ, ত্রুহিয়্যো সংস্কৃতিবান কোনো মানুষ নয়, খুবই অমার্জিত। কিন্তু অনেক একনায়কের মতো সহজাত জ্ঞান তার ছিল। ফলে দ্রুত মানুষের দুর্বলতা শনাক্ত করতে পেরেছে। ত্রুহিয়্যো জানত মানুষের কোন দুর্বলতায় ঘা দিয়ে তার স্বাধীনতা ধ্বংস করা যায়। তার চারপাশের সহযোগীদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে তা হচ্ছে সবার মধ্যে পুরোপুরি নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করা।
কাজেই তার সবচেয়ে কাছাকাছি মানুষেরা [বন্ধু নয়, আমি মনে করি তার বন্ধু ছিল না] ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা জানত তাদের চাকরির নিরাপত্তা নেই। ত্রুহিয়্যোকে বিশ্বাস নেই, প্রতিদিনই সবকিছু বদলে যেতে পারে। সে কারণেই তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করত, ত্রুহিয়্যোর কাছে প্রমাণ করতে চেষ্টা করত দাসত্বে, আনুগত্যে আর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। আর এটা সমাজের বৃহত্তর অংশে বিস্তার লাভ করেছে। এক সময় সমাজের ওপর তার এমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার যে কোনো পাগলামি, যে কোনো উদ্ভট কাজও সমাজ মেনে নেয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যায় : ত্রুহিয়্যো যখন তার ছেলেকে জেনারেল পদে অভিষিক্ত করে, আমার ধারণা তখন সেই ছেলের বয়স ১১ বছর। এ উপলক্ষে সেনা কুচকাওয়াজের সরকারি উৎসব হয়। বহু লোক সমবেত হয় এবং তারা ডোমিনিকান সেনাবাহিনীর তরুণতম জেনারেল ১১ বছর বয়সী জেনারেলকে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়।
এটা হাস্যকর আবার একই সঙ্গে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনাও। মানুষ তখন ভয়ঙ্কর দুর্নীতিগ্রস্ত। এমনকি এ ধরনের প্রহসনের জীবনে বিরোধীরাও জড়িত থাকত। কেবল ত্রুহিয়্যোর একনায়কত্ব নয়, সব একনায়কত্বের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হচ্ছে আত্মিক দুর্নীতি- এটাও একনায়কত্বের ফল।