বিশ বছর আগে, সে আগাম আন্দাজ করে উঠতে পারেনি যে, তার নীরবতাকে ভেঙে দেবে এমন একটি অচেনা ভাষা, নিজের মাতৃভাষার সাথে যেটির সাদৃশ্য নেই বললেই চলে।
Published : 01 Apr 2025, 05:21 PM
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হান কাঙের মোট আটটি উপন্যাসের মধ্যে এটি পঞ্চম, তবে ইংরেজিতে প্রকাশের হিশেবে চতুর্থ। ২০১১ সালে কোরীয় ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পরে ২০২৩ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রথমবার হান কাঙের একাকী ইংরেজি অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ তরুণ এক কোরীয় অনুবাদক এমিলি ইয়ে ওয়ানের সাথে যুগলবন্দি রচনা করেছেন, যা, আশা করা যায়, তাঁর অনুবাদের মর্মগ্রাহিতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, অনুবাদে মূল পাঠের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা যেন আরও নিপুণ অক্ষরে ফুটে ওঠে তা নিশ্চিত করেছে, এবং অনুবাদকের স্বভাবসুলভ বিচ্যুতিপ্রবণতা থেকে অনূদিত পাঠটিকে আরও সজাগ ও-সুযোগ্যভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। বাংলা অনুবাদটি যেহেতু এই ইংরেজি অনুবাদের মারফত মূল কোরীয় উপন্যাসটির রূপ-রস- ও গন্ধ বাংলাভাষী পাঠকের সংবেদনশক্তির নিকট নিবেদন করছে তাই এ-তথ্যটুকু উৎসাহব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। আজ প্রকাশিত হলো উপন্যাসটির দ্বিতীয় কিস্তি।
তবে তার মায়ের স্মৃতিতে সে ‘সত্যিকার মেধাবী’ হলেও, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দিনগুলোয় কেউ তাকে খেয়াল করেনি। সে অঘটনপটিয়সী ছিলো না, আবার তার পরীক্ষার নম্বরও আহামরি ছিলো না। হ্যাঁ, তার ক’জন বন্ধু ছিলো ঠিকই, তবে বিদ্যালয়ের বাইরে কোনো মেলামেশা হতো না। মুখ ধুতে হলেই কেবল সে আয়নার সামনে সময় কাটাতো; বিদ্যালয়ের অন্য মেয়েদের মতো ছটফটে সে ছিলো না, আর প্রেম করার ঘোলাটে বাসনা তাকে বলতে গেলে কখনোই বিচলিত করেনি। দিনের পড়াশোনার পাট চুকলে, সে সোজা রওনা হতো স্থানীয় পাঠাগারের দিকে এবং পড়তো বিদ্যালয়ের পড়ার সাথে সম্বন্ধহীন কোনো একটি বই, গোটা কয়েক বই সাথে করে বাড়ি নিয়ে যেতো, কম্বলের তলায় গুটিয়েশুটিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তো। তার জীবন যে সহিংসভাবে ভেঙে দু’টুকরো করে রাখা হয়েছে তা শুধু সে নিজেই জানতো। ডায়েরির পেছনে যে-শব্দগুলি সে টুকে রেখেছিলো তারা অচেনা সব বাক্য তৈরি করবে বলে স্বেচ্ছায় কিলবিলিয়ে চলে যেতো এদিক-ওদিক। শব্দেরা যখন-তখন লোহার শিকের মতো সটান সেঁধিয়ে যেতো তার ঘুমের ভেতরে, এক রাতেই বার কয়েক তাকে চম্কে জাগিয়ে তুলতো। দিন-দিন ঘুম কমতে থাকলো তার, বাড়তে থাকলো ইন্দ্রিয়গত বিভিন্ন উদ্দীপকে তার বিহ্বলতা, এবং কখনো কখনো ছ্যাঁকা-মার্কা বসানোর তপ্ত লোহার মতো তার পেটের স্নায়ুজালিকায় জ্বলুনি ধরাতো একরকম ব্যাখ্যাতীত যন্ত্রণা।
সে মুখ খুলে এক এক করে শব্দগুলোকে যখন ঠেলে বের করতো তখন সেগুলোকে যেমন ভীতিকরভাবে প্রস্ফুট শোনাতো সেটা ছিলো সবচাইতে যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। নিতান্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ পদবন্ধও বরফের শীতল স্বচ্ছতায় মূর্ত করে তুলতো সম্পূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতাকে, সত্য ও মিথ্যাকে, সৌন্দর্য ও কদর্যতাকে। তার জিভ থেকে আর হাত দিয়ে মাকড়শার রেশমের মতো শাদা সুতো হয়ে বের হওয়া ওই বাক্যগুলো ছিলো লজ্জাজনক। তার বমি করতে ইচ্ছে হতো। চিৎকার করতে ইচ্ছে হতো।
যে-শীতকালে সে সবে ষোলোয় পড়েছিলো সে-বার ওটা প্রথম ঘটলো। হাজার সূচের তৈরি কাপড়ের মতো করে যে-ভাষা তাকে খুঁচিয়েছিলো আর আবদ্ধ করে রেখেছিলো সেটা আচমকাই উধাও হয়ে গেলো। শব্দেরা এখনো তার কানে পৌঁছতো, তবে এখন পুরু, গাঢ় একটি বায়ু-স্তর তার কর্ণকুহর ও মস্তিষ্কের মাঝখানকার জায়গাটিকে সুরক্ষা দিতো। সেই কুয়াশাছাওয়া নৈঃশব্দ্যে আচ্ছন্ন থাকায় উচ্চারণের কাজে ব্যবহৃত জিভ ও দুই ঠোঁট এবং শক্ত করে পেন্সিল ধরে থাকা হাতের স্মৃতি দূরবর্তী হয়ে উঠলো। সে আর ভাষার মারফত ভাবতো না। সে ভাষা ছাড়াই চলতো এবং ভাষা ছাড়াই বুঝতো— যেমনটা ছিলো আর কী কথা বলা শেখার আগে, না, জীবন লাভ করার আগে, সময়প্রবাহকে কতোগুলো তুলোর বলের মতো শুষে নেওয়া নৈঃশব্দ্য তার শরীরকে ভেতরে-বাইরে ঢেকে রেখেছিলো।
তার উদ্বিগ্ন মা যে-মনোচিকিৎসকের কাছে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি তাকে ট্যাবলেট দিলেন, যেগুলো সে জিভের নিচে লুকিয়ে রেখে পরে বাড়ির ফুলের কেয়ারিতে পুঁতে ফেলতো, এবং দুই মরশুম পেরিয়ে গেলো আর সে উঠানের ওই কোণেই উবু হয়ে বসে থাকলো যে-কোণে বহু দিন আগে বিকেলের রোদ পোহাতে পোহাতে সে স্বর-ব্যঞ্জন মালুম করেছিলো। গ্রীষ্ম আসার আগেই তার ঘাড় রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেলো, এবং খ্যাপাটে চেহারার কিছু ফুসকুড়ি দেখা দিলো তার নাকের গোড়ায়, যে-নাক ছিলো চিরদিন ঘাম-চিকচিকে। তার পুঁতে দেওয়া ঔষধে পরিপুষ্ট কেয়ারির স্যালভিয়া গাছে যতোদিনে ঘন লাল পরাগকেশর গজাতে শুরু করলো, ততোদিনে মনোচিকিৎসক ও তার মায়ের আলাপ-আলোচনার ফলে তাকে বিদ্যালয়ে ফেরত পাঠানো হলো। বাড়িতে আটকা পড়ে থেকে তার যে কোনো উপকার হয়নি সেটা ছিলো স্পষ্ট, আর নিজের সহপাঠীদের পেছনে পড়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়।
বিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষাবর্ষ মার্চ মাস থেকে শুরু হচ্ছে এমন ঘোষণাসম্বলিত চিঠিটি তাদের দুয়ারে এসে পড়ার কয়েক মাস বাদে যে-সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো সে ভর্তি হচ্ছিলো সেটি ছিলো একটি নিরানন্দ, ভীতিসঞ্চারী জায়গা। পাঠদান ততোদিনে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলো। বয়স নির্বিশেষে শিক্ষকেরা ছিলেন জাঁদরেল। তার কোনো সহপাঠীই এমন একটি মেয়েকে নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাতো না যে কিনা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রা-টুকুও কাড়ে না। তাকে যখন পাঠ্যপুস্তকের কিছু পড়তে ডাকা হতো কিংবা শারীরিক শিক্ষায় জোরগলায় সংখ্যা গুনতে বলা হতো, তখন সে শূন্যদৃষ্টিতে শিক্ষকদের দিকে চোখ তুলে চাইতো এবং বিনা ব্যত্যয়ে তাকে শ্রেণিকক্ষের পেছনে চলে যেতে হতো অথবা গালে চড় খেতে হতো।
তার মা আর মনোচিকিৎসক আশা করেছিলেন ঠিকই, তাই বলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার উদ্দীপনা তার নীরবতায় চিড় ধরাতে পারলো না। বরঞ্চ আরও উজ্জ্বল এবং আরও নিবিড় স্তব্ধতা তার শরীরের মৃৎপাত্রকে ভরিয়ে তুললো। বাড়ি ফেরার জনাকীর্ণ রাস্তায় সে হাঁটতো ভরশূন্য হয়ে, যেন মস্ত এক সাবানের বুদবুদের ভেতরে বন্দি হয়ে পথ চলছে সে। পানির নিচ থেকে জলপৃষ্ঠের পানে তাকিয়ে থাকা যেমন তেমনটাই ঝিকমিকে নিস্তব্ধতার ভেতরে, বজ্রনির্ঘোষ তুলে পাশ দিয়ে চলে যেতো গাড়ি আর পথচারীদের কনুই তার কাঁধে-বাহুতে হুটহাট গুঁতো দিয়ে হাওয়া হয়ে যেতো।
অনেকটা কাল পেরিয়ে যাওয়ার পরে, তার মনে সন্দেহ জাগতে শুরু করলো।
সেই শীতকালে ছুটির দিনগুলোর ঠিক আগে ওই পুরোদস্তুর শাদাসিধে পাঠের ওই পুরোদস্তুর শাদাসিধে ফরাসি শব্দটি যদি তার ভেতরে কিছু-একটা জ্বালিয়ে না দিয়ে থাকে, তাহলে? যদি একটি রুগ্ণ অঙ্গের অস্তিত্ব মনে পড়ার মতো করে আপনা-আপনিই তার মনে সেদিন ভাষা না এসে থাকে, তাহলে?
ধরুন ধ্রুপদি চিনা বা ইংরেজি না হয়ে ফরাসি কেন, হতে পারে এর অভিনবত্বের জন্যে, হতে পারে যে, এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকায় এমন একটা ভাষা শেখার ব্যাপারটা তার বেছে নেওয়া সম্ভব ছিলো। যথারীতি নির্লিপ্তভাবে তার দৃষ্টি উঠেছিলো ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে, তবে ওটা সেখানে কিছু-একটায় আটকে গিয়েছিলো। বেঁটে, হবু টাকওয়ালা ফরাসি ভাষার শিক্ষক উচ্চারণ করতে করতে শব্দটির দিকে ইশারা করছিলেন। আলটপকা সে টের পেলো যে, একটি শিশুর ঠোঁটের মতো কাঁপতে-কাঁপতে সচল হচ্ছে তার ঠোঁট দু’টি। বিব্লিওতেক। অস্ফুট ধ্বনিটি বেরিয়ে এসেছিলো তার জিভ ও কণ্ঠের চাইতে গহিনতর কোনো স্থান থেকে।
কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ওই মুহূর্তটি সেসময় তা জানা থাকার কোনো উপায় তার ছিলো না।
তখনো আতঙ্ক ছিলো একেবারেই ক্ষীণ, নৈঃশব্দ্যের গহন থেকে বেদনা তার জ্বলন্ত বর্তনী উন্মোচনে ছিলো দ্বিধান্বিত। বানান, ধ্বনিমূল ও শিথিল অর্থ যেখানে মিলিত হলো, সেখানে প্রজ্বলিত হলো ধীরেধীরে-পোড়া সুখশিহরণ ও সীমালঙ্ঘনের সলতে।
****
মহিলাটি দু’টি হাতই রাখে ডেস্কের ওপরে। আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় সে এমন করে ঝুঁকে থাকে যেন আঙুলের নখ পরখ করাবে বলে অপেক্ষা করছে একটি শিশু। লোকটির কণ্ঠস্বরকে সে বক্তৃতাকক্ষ গমগমিয়ে তুলতে শোনে।
“কর্মবাচ্য ও কর্তাবাচ্যের সাথে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় তৃতীয় আরেকটি বাচ্য আছে, যেটা আমি আপনাদেরকে গত পাঠে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছিলাম, তা-ই না?”
মহিলাটি যে-সারিতে আছে সেই একই সারিতে বসে থাকা তরুণ জোরালোভাবে মাথা ঝাঁকায়। সে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত দর্শনের ছাত্র, যার গোলাকার পুরুষ্টু গাল দেখলে মনে হয় চালাক, দুষ্টু একটা বাচ্চা।
মহিলাটি জানালার দিকে তাকাবে বলে মাথা ঘোরায়। তার দৃষ্টি চলে যায় ওই স্নাতকোত্তর ছাত্রটির পার্শ্বদৃশ্যের ওপর দিয়ে, যে কিনা প্রাক-ডাক্তারি পড়াশোনাটা কষ্টেসৃষ্টে উতরে গেলেও অন্যের প্রাণের দায়দায়িত্ব নেওয়ার হিম্মত যার ছিলো না, কাজেই সেটা ছেড়ে দিয়ে ঔষধশাস্ত্রের ইতিহাস ধরেছিলো। আকৃতিতে সে বড়োসড়ো আর তার রয়েছে গোলগাল, গলকম্বলওয়ালা চেহারা, গোলাকার, কালো, শিংমার্কা-বেড়যুক্ত চশমা, এবং তাকে প্রথম দেখায় মনে হয় যেন সহজিয়া চালের। প্রতিটা বিরতি সে কাটায় তরুণ দর্শনের ছাত্রটির সাথে – তারা দু’জনে পালাক্রমে ঝনঝনে গলায় অসার সব কৌতুক বলাবলি করে। কিন্তু পাঠদান শুরু হওয়া মাত্রই তার আচরণ বদলে যায়। যে-কারো চোখে পড়ার কথা যে, সে কতোটা টানটান হয়ে রয়, কোনো ভুল করে বসে কিনা তা নিয়ে আতঙ্কিত থাকে।
“যেটাকে আমরা বলি কর্মকর্তাবাচ্য সেই বাচ্যটি কর্তার সাথে আত্মবাচকভাবে সম্পৃক্ত একটি ক্রিয়াকে প্রকাশ করে।”
দোতলার জানালার বাইরে, ইতিউতি ছড়ানো কমলা বিন্দুগুলো নিচু নিচু বিষাদমাখা ভবনকে আলোকিত করে রাখে। চওড়া পাতার নবীন গাছগুলি অন্ধকারে লুকায় তাদের শীর্ণ কালো ডালপালার উদোম আদল। তার দৃষ্টি নীরবে পেরিয়ে চলে সেই হতশ্রী দৃশ্যপট, স্নাতকোত্তর ছাত্রটির ভীতসন্ত্রস্ত মুখচ্ছবি, প্রভাষকের পাংশু কবজি।
বিশ বছর পরে এখন যে-নৈঃশব্দ্য ফিরে এসেছে তা আগের মতো আদৌ উষ্ণ বা নিবিড় বা উজ্জ্বল নয়। সেই আদি নৈঃশব্দ্যের মিল যদি থাকে জন্মের আগেকার নৈঃশব্দ্যের সাথে, তাহলে এই নতুন নৈঃশব্দ্যের বেশি মিল আছে মৃত্যু-পরবর্তী নৈঃশব্দ্যের সাথে। আগেকার সময়ে সে নিমজ্জিত থাকতো পানির নিচে, তাকিয়ে থাকতো ওপরের ঝকমকে পৃথিবীর দিকে, আর এখন মনে হচ্ছে সে একটি ছায়ায় পরিণত হয়েছে, যে-ছায়া দেয়াল ও ন্যাড়া ভূতলের শীতল, কঠিন পিঠে চড়ে থাকে, যেন প্রকাণ্ড একটি জলাধারে রক্ষিত জীবনের বহিঃস্থ পর্যবেক্ষক। সে প্রত্যেকটি শব্দ শুনতে পায় ও পড়তে পারে ঠিকই, কিন্তু তার ঠোঁটদু’টি ধ্বনি ফোটানোর জন্যে ফাঁক হওয়ার নয়। কোনো অশরীরী ছায়ার মতোন, কোনো মৃত গাছের ফাঁপা খোড়লের মতোন, দুই উল্কার মাঝখানকার সেই অন্ধকার মহাশূন্যস্থিত ফাঁকা জায়গার মতোন, এ হচ্ছে এক তিক্ত, পাতলা নৈঃশব্দ্য।
বিশ বছর আগে, সে আগাম আন্দাজ করে উঠতে পারেনি যে, তার নীরবতাকে ভেঙে দেবে এমন একটি অচেনা ভাষা, নিজের মাতৃভাষার সাথে যেটির সাদৃশ্য নেই বললেই চলে। এই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাচীন গ্রিক শেখার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে কেননা সে নিজ ইচ্ছায় ভাষার ওপরে ফের প্রতিষ্ঠা করতে চায় তার অধিকার। হোমার, প্লেটো ও হেরোডোটাসের সাহিত্য, কিংবা তার সহপাঠীরা প্রাকৃত গ্রিকে লেখা পরবর্তী কালপর্বের যেসব সাহিত্য মূল ভাষায় পড়তে চায় সেসব নিয়ে সে বলতে গেলে মোটেই আগ্রহী নয়। বর্মি বা সংস্কৃতের মতো যেসব ভাষায় আরও অচেনা লিপি ব্যবহৃত হয় সেসব নিয়ে যদি বক্তৃতামালার বন্দোবস্ত থাকতো, তাহলে গ্রিকের বদলে সেগুলোই সে বেছে নিতো।
“উদাহরণসূত্রে বলা যায়, ‘ক্রয় করা’ এই ক্রিয়াটিকে কর্তাকর্মবাচ্যে ব্যবহার করা হলে, ‘আমি নিজের জন্য ক ক্রয় করি’-এর আদত অর্থ দাঁড়ায় ‘আমার ক আছে’। কর্তাকর্মবাচ্যে রূপায়িত ‘ভালোবাসা’ ক্রিয়াটি, ‘ক-কে ভালোবাসা হয়’-এর আদত অর্থ দাঁড়ায় ক আমার মধ্যে ভালোবাসা জাগায়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘He killed himself’, তাই না? প্রাচীন গ্রিকে ‘himself’ বলার দরকার পড়ে না – আমরা যদি কর্তাকর্মবাচ্য ব্যবহার করি তাহলে একটিমাত্র শব্দে এই একই অর্থ প্রকাশ করা যায়। এইভাবে,” বলতে বলতে প্রভাষক ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন: ἀπήγξατο।
ব্ল্যাকবোর্ডের বর্ণগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে তার পেন্সিল তুলে নিয়ে খাতায় শব্দটি লিখে ফেলে। এর আগে এমন জটিল নিয়মকানুনবিশিষ্ট ভাষার দেখা সে পায়নি। ক্রিয়াগুলি রূপ বদলায় বহুবিধ কিছুর নিরিখে : কর্তার লিঙ্গ ও বচন; ক্রিয়ার ভাব; ক্রিয়ার কাল, যার কিনা রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়; এবং বাচ্য, যাতে রয়েছে তিনটি পৃথক ধরণ। তবে এ অসামান্য রকমের সুবিস্তৃত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়মকানুনের সুবাদেই আলাদা করে একেকটি বাক্য সত্যিসত্যি সোজাসরল ও স্পষ্ট হয়। সুনির্দিষ্টভাবে কর্তা উল্লেখের প্রয়োজন নেই, এমনকি কড়াক্কড় কোনো পদক্রমও অটুট রাখতে হয় না। এই একটি শব্দ – এমনভাবে বিগঠিত যাতে করে বোঝানো যায় যে, কর্তা হচ্ছে একবচন, পুংলিঙ্গীয় অন্যপক্ষ; ক্রিয়ার কাল হচ্ছে পুরাঘটিত, যার মানে এই কাল অতীতের কোনো এক সময়ে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে নির্দেশ করে; আর বাচ্য হচ্ছে কর্তাকর্ম – নিজের ভেতরে এ-অর্থটুকু ঠেসে রেখেছিলো ‘সে (পুরুষ) কোনো একটা সময়ে নিজেকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলো’।
তার যে-বাচ্চাটিকে আট বছর আগে সে পেটে ধরেছিলো এবং যার দেখাশুনার কাজে এখন তাকে অযোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে সেই বাচ্চাটি যেসময়ে প্রথম কথা বলতে শিখেছিলো অনেকটা সেসময়েই সে এমন একটি শব্দের স্বপ্ন দেখেছিলো যাতে সমগ্র মানব-ভাষা রয়েছে অন্তর্ভূত। এ এতো জীবন্ত দুঃস্বপ্ন ছিলো যে, ঘামে ভিজিয়ে জবজবে করে ছেড়ে যেতো তাকে। প্রচণ্ড ঘনত্ব ও অভিকর্ষের সাহায্যে দৃঢ়বদ্ধ একটিমাত্র শব্দ। এমন এক ভাষা, যা হাঁ করে কেউ এটি উচ্চারণ করা মাত্রই বিস্ফোরিত হয়ে যাবে, প্রসারিত হবে, যেমনটা বিশ্বজগতের সূচনায় সমগ্র পদার্থের ক্ষেত্রে হয়েছিলো। যে-বারই তার ক্লান্ত, অস্থির বাচ্চাটিকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সে নিজেই খানিক তন্দ্রায় ভেসে যেতো, সে-বারই সে স্বপ্নে দেখতো যে, তার স্পন্দনরত নিলয় দু’টির ভেতরে রক্ষিত সমগ্র ভাষার অগাধ স্ফটিকীভূত পিণ্ডটিকে তার তপ্ত হৃদপিণ্ডের মধ্যখানে একটি বরফশীতল বিস্ফোরকদ্রব্যের মতো সলতে পরানো হচ্ছে।
ওই যে-অনুভূতিটির স্মৃতিটুকুও করে দেয় হিমজমাট, সেটিকেই প্রাণপণে কামড়ে ধরে সে লেখে: ἀπήγξατο।
একটি বরফস্তম্ভের মতো শীতল ও কঠিন এক ভাষা।
এমন এক ভাষা যার ব্যবহার আর কোনো ভাষার সাথে সম্মিলিত হওয়ার অপেক্ষা রাখে না, একটি পরম স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা।
এমন একটি ভাষা যা কারণবাচকতা ও বাচনরীতি অমোঘভাবে নির্ধারণ করেই তবে দুই ঠোঁট ফাঁক করে।