বিচারপতি রাধাবিনোদ পালই হবেন প্রথম এশিয়ান যিনি টোকিও টাইব্যুনালকে বিজয়ীর প্রহসন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন; প্রথম প্রতিবাদী হিসেবে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা ফেলার জন্য আমেরিকাকে অভিযুক্ত করেছেন।
Published : 31 Mar 2025, 10:57 AM
প্রাচীনকালের কথা বাদ দিলে আধুনিক ব্রিটিশ-ভারতের যুগে জাপানি-বাঙালির সম্পর্ক ও সম্প্রীতি নানাদিক দিয়েই সমুজ্জ্বল। যদিও বা সেই ইতিহাস দুদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে একরকম অজানাই বলা চলে। তথাপি জাপান-বাংলা-ভারতের ধর্ম-সংস্কৃতি-শিক্ষা-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ও তাৎপর্য বহন করে চলেছে।
আমরা এমন কতিপয় ব্যক্তিত্বকে দুই অঞ্চল থেকে নির্বাচিত করতে পারি যাঁদের প্রভাব জাপান ও বাংলা অঞ্চলের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে এখনো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিদ্যমান। যেমন, সর্বনমস্য ওকাকুরা তেনশিন-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তোওয়ামা মিৎসুরু-রাসবিহারী বসু, শিমোনাকা ইয়াসুবুরোও-রাধাবিনোদ পাল, তোজো হিদেকি-সুভাষচন্দ্র বসু এবং হায়াকাওয়া তাকাশি-শেখ মুজিবুর রহমান। এঁরা কারা? এঁরা সবাই ছিলেন উদার জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব স্ব স্ব ক্ষেত্রে। এঁরা ছিলেন প্যান-এশিয়ানিস্ট। এঁরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এঁদের নিয়ে বাংলা ভাষায় গবেষণা হয়নি বলেই এঁদের জীবন, কর্ম, লক্ষ্য ও সাধনা সম্পর্কে বাঙালি পরিজ্ঞাত নয়। কিন্তু এঁদের জীবন ও কর্ম থেকে আমাদের শেখার আছে বিস্তর। আমরা রবীন্দ্রনাথকেই অর্ধেকের বেশি আবিষ্কার করতে সক্ষম হইনি আর বাকিদের ক্ষেত্রে সিকি পরিমাণ তো নয়ই!
এটা সত্যি যে একমাত্র রাজনৈতিক সচেতনতা জাপান ও ব্রিটিশ-ভারতকে কাছাকাছি এনেছিল। যদিও বা সহস্রবর্ষপ্রাচীন ধর্মীয় সম্পর্ক বিদ্যমান দুদেশের মধ্যে কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনা বিংশ শতকে জাপান ও বাংলাকে ঘনিষ্ঠ করে তোলে। তখন রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষার দিক থেকে ভারত বলতে বাংলা অঞ্চলকেই বোঝাত। এখনো বহু জাপানি নাগরিক জাপান-ভারত সম্পর্ক বলতে জাপান ও উভয় বাংলাকেই বোঝেন!
বিচারপতি পালের রায়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিশ্বযুদ্ধের পর
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ সবাই চেয়েছিলেন দখলদার শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবল থেকে মহাএশিয়ার সার্বিক মুক্তি, আঞ্চলিক স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার প্রথম এবং দ্বিতীয় উত্থান ঘটে অবিভক্ত বাংলা এবং জাপানে। বাংলায় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে রক্তপাতের ভিতর দিয়ে। এই যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজ দালালদের হাতে নিহত হন। মধ্যযুগের জাপান এই ঘটনা জানত কিনা জানি না তবে আধুনিককালে দুটি আফিম যুদ্ধ বা ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২, ১৮৫৬-৬০) সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল। কেননা চিন ছিল তার পাশ্ববর্তী দেশ। জাপানও বহু বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শক্তির লক্ষ্যবস্তু ছিল। পলাশি যুদ্ধের প্রায় একশ বছর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী প্রধান কমোডোর ম্যাথু পেরি ১৮৫৩ সালে যখন জাপানকে শাসিয়ে গেল তার দুশ বছরের বন্ধ দরজা খোলার জন্য তখন জাপান প্রমাদ গুনল। তার সামনে তখন দুদুটো আফিম যুদ্ধের রক্তাক্ত উদাহরণ। তাই সে শান্তিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ দরজা উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয় এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সামুরাই শাসনব্যবস্থা থেকে রাজকীয় শাসনব্যবস্থা তথা সম্রাটের অধীন জাপান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ১৮৬৮ সালে যাকে বলা হয় মেইজি রেস্টোরেশন বা মেইজি মহাসংস্কার। প্রকারান্তরে এটা ছিল জাপানের জন্য একরকম পরাজয়; জাতিগত এবং মানসিক দিক দিয়ে। সামুরাই শক্তির অধিকারী জাপানিরা এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি বলেই শ্বেতাঙ্গ শক্তির সমকক্ষ হতে চেয়েছিল। কতখানি সমকক্ষ এবং এশিয়া থেকে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তাড়াতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল রুশ-জাপান যুদ্ধ (১৯০৪-৫) এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে (১৯৪১-৪৫) তা ভালোভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিনী ষড়যন্ত্রের শিকার এবং পরাজিত জাপানের কারণেই এশিয়ার দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যেই ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রণী বিপ্লবীরা জাপানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য একদিনে এই রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি; অনেক সময় যেমন লেগেছে, তেমনি বহু ঘটনারও জন্ম হয়েছে। সে ইতিহাস খুব কমই লিখিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। কাজেই সেই ইতিহাস বর্ণিত হলে উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কের কথাও বেরিয়ে আসবে।
তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচারপতি ড.রাধাবিনোদ পাল সবচেয়ে আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব। তিনি যেরকম গভীর অভিনিবেশের মাধ্যমে জাপানি জাতিকে অনুসন্ধান করে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন এমনটি আর কোনো বাঙালি নয় বলেই মনে হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানকে তাঁর মাতৃভূমির বাইরে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন, তিনিও জাপানকে বিচারপতি পালের মতো বুঝতে পেরেছিলেন কিনা সন্দিহান অনেক জাপানি। ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দি ফার ইস্ট সংক্ষেপে টোকিও ট্রাইব্যুনাল (১৯৪৬-৪৮) তথা তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ১১টি দেশের বিচারপতিদের মধ্যে ড.পাল ছিলেন ভারতের প্রতিনিধি। আড়াই বছরের বেশি সময় নিয়ে অনুষ্ঠিত এই বিচারের রায় লেখার জন্য টোকিও ইম্পেরিয়াল হোটেলের কক্ষে প্রায় স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে জাপানি ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদিসহ বহির্বিশ্ব থেকে গ্রন্থ আনিয়েছিলেন যার সংখ্যা সব মিলিয়ে ৩,০০০ বলে কথিত আছে। এসব পাঠ করার পর ইংরেজিতে ৭০০ পৃষ্ঠার রায় লিখেছিলেন। এই রায়ের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিসহ মিত্রশক্তি কর্তৃক যুদ্ধাপরাধী বলে অভিযুক্ত ২৮ জনকেই নির্দোষ বলে ঘোষণা করেন। যদিও বা এই রায় তাকে পাঠ করতে দেয়া হয়নি আদালতে, কিন্তু একমাত্র এই দীর্ঘ নির্দোষ রায়টি সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের বদলৌতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং সৃষ্টি করে ইতিহাস। এই রায়ের কিছু কিছু অভিমত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। রায়ের কোনো কোনো মন্তব্য আজও স্মরণীয়। কোনোকালেই যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক কোনো আইন ছিল না এই রায়ের পর বিশ্বআইন পরিষদ এই প্রথম সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। ১৯৫২-৬৬ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ল কমিশন-এর সদস্য নির্বাচিত হন বিচারপতি পাল। নিঃসন্দেহে এটা বিরল সম্মান। এখনো যখন কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার অনুষ্ঠিত হয় তাঁর মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়: বিচার যেন ‘ভিক্টর’স জাস্টিস’ বা ‘বিজয়ীর বিচার’ না হয়ে যায়!
হিরোশিমা সেনোটাফের সম্মুখে বিচারপতি পাল
২
বিচারপতি পালের অনেক ঘটনা আছে জাপানে যেগুলো তৎকালীন পত্রপত্রিকা এবং তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত পুত্রসম শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার তানাকা মাসাআকি লিখেছেন একাধিক গ্রন্থে। ন্যাশনালিস্ট তানাকার গ্রন্থ থেকেই জানা যায় যে, বিচারচলাকালীন তিনি একাধিক প্রভাবশালী জাপানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও অন্যতম। তাঁকে বিচারপতি পালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তানাকাই। শিমোনাকা ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক নমস্য ব্যক্তিত্ব। মৃৎশিল্পী, শিক্ষাবিদ, জাপানের প্রথম আধুনিক প্রকাশনা জগতের পথিকৃৎ, সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠাতা, নারীশিক্ষার উদ্যোক্তা এবং শান্তি আন্দোলনের প্রধান সংগঠক। শিমোনাকা ও পালের বন্ধুত্ব দ্রুত ভাতৃবন্ধনে পরিণত হয়েছিল। তাঁদের দুজনের একান্ত বিশ্বস্ত শিষ্য তানাকার উদ্যোগেই ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয়েছে পাল-শিমোনাকা স্মৃতিজাদুঘর কানাগাওয়া-প্রদেশের হাকানো নামক শহরের উপকণ্ঠে এক পাহাড়ের নির্জন স্থানে। তানাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও আমৃত্যু ভক্ত ছিলেন। বিচারচলাকালীন ড.পাল অভিযুক্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তোজো হিদেকির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন সুগামো প্রিজন কারাগারে। তোজোর পৌত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পরিবেশবাদী ও ইতিহাস গবেষক শ্রীমতী তোজো য়ুকোর সঙ্গে আলাপকালে এই লেখককে তিনি জানান যে, বিচারপতি পালের সঙ্গে তোজোর পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তোজোর পরিবারের সঙ্গে ড.পালের ছবিও রয়েছে। জেনারেল তোজোর প্রতি বিচারপতি পাল ছিলেন খুবই সহানুভূতিশীল, কারণ তিনি ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তোজো ছিলেন দেশ, সম্রাট ও জাতির মর্যাদারক্ষার শেষ ত্রাণকর্তা এবং দেশি-বিদেশি যড়যন্ত্রের শিকার মাত্র। তাছাড়া আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ পটভূমি তোজো তথা জাপানকে নির্দোষ প্রমাণ করার ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। সেটা হল: পরাধীন মাতৃভূমি ভারতের স্বাধীনতা। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তোজো এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে একাত্ম হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তোজো না থাকলে ভারতের স্বাধীনতা কবে আসত আজ তা ধারণা করাও কঠিন।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অধীন দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া ইউনিয়নের সালিমপুর গ্রামের এক অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম (১৮৮৬) রাধাবিনোদ পাল কৈশোরকাল থেকেই রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন এবং প্রত্যক্ষ করেছিলেন গ্রামগঞ্জশহরে শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বৈষম্য এবং অন্যায়-অত্যাচার। তাই ছাত্রজীবন থেকেই জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। রুশ-জাপান মহাযুদ্ধে জাপানের বিজয় তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে আশ্রিত বিপ্লবী মহানায়ক রাসবিহারী বসুর প্রচেষ্টায় যখন তোজো ও নেতাজি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ে হাত মেলান তখন ড.পাল নিশ্চয়ই আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন। তরুণকালের দুরন্ত আবেগ পরিণত বয়সে এসে বিমূর্ত উপলদ্ধিতে অবস্থিতি লাভ করেছিল বলাই বাহুল্য।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কঠোর মনোভাব, স্বদেশপ্রেম এবং জাপানের প্রতি দুবর্লতা তাঁর রায় লেখার পেছনে কাজ করেছে বলে বললে অত্যুক্তি হবে না। এই ধারণাকে অস্বীকার করা যাবে না এই কারণেই যে, এখানে আবেগের কোনো স্থান নেই--দুশ বছরের ভারত শাসন এবং জাপানকে সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ ও মহাষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধে জড়ানোর অন্তরালে শ্বেতাঙ্গদের চিরকালীন আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গিরই সমালোচনা করা হয়েছে এই রায়ে। এশিয়া মহাদেশে জাপান নয়; ব্রিটিশ, ওলন্দাজ, স্পেন, পর্তুগীজ, ফরাসিরাই প্রথম সাম্রাজ্যবাদী। নাৎসি জার্মানির মতো পরিকল্পিত গণহত্যা আর জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত মানুষহত্যা এক জিনিস নয়--এই দুটো বিষয় তিনি সুস্পষ্টভাবেই জানতেন। তারপরও বলেছেন, চিনে গণহত্যার জন্য যদি জাপান যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে থাকে তাহলে, একই কারণে সাধারণ নাগরিক অধ্যুষিত হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের জন্য আমেরিকাও সমানভাবে অভিযুক্ত। বিচার আমেরিকারও হওয়া উচিৎ। আমেরিকা আজ পর্যন্ত এই যুক্তি খণ্ডন করতে পারেনি। প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা। শুধু তাই নয়, বিচারপতি পালের রায়ের পক্ষে আজও বিশ্বের অধিকাংশ ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, রাজনীতিক, আইনজ্ঞ, গবেষক, কবি, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার শান্তিবাদী মানুষ সমর্থন দিয়ে আসছেন। এটা আজ এক মহামূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও। উল্লেখ্য যে, ট্রাইব্যুনালের ১১জন বিচারপতির মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন আইনজ্ঞ আর কেউ নয়। তাহলে এটা বিচার হল কীভাবে--এই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে, মিত্রশক্তি প্রধান আমেরিকা এমন একটি সময়ে তড়িঘড়ি করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই বিচার শুরু করেছিল যখন যুদ্ধে বিধ্বস্ত বহু দেশ; ভারতও তখন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় পর্যবশিত--টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ কারো ছিল না। এশিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার এই সুযোগটি দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তথাপি, ভারতীয় বাঙালি হিসেবে বিচারপতি পাল এই ঐতিহাসিক রায় লিখে যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন তার জুড়ি মেলা ভার! শুধু তাই নয়, বিচারপতি রাধাবিনোদ পালই হবেন প্রথম এশিয়ান যিনি টোকিও টাইব্যুনালকে বিজয়ীর প্রহসন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন; প্রথম প্রতিবাদী হিসেবে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা ফেলার জন্য আমেরিকাকে অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু এই রায়ের মধ্যেই তিনি বিশ্বশান্তি রক্ষার উপায়ও বাৎলে দিয়েছেন। যে কারণে এই রায় একটি মহান দিকনির্দেশনা ভবিষ্যৎ মানবকল্যাণের জন্য।
হিরোশিমা শান্তি সম্মেলনের সভাপতি বিচারপতি পাল
৩
বিচারপতি পালের জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিরোশিমাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দান। যুদ্ধের পর ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট মুভমেন্ট জাপান ( WFMJ ) শাখার উদ্যোগে আণবিক বোমা দ্বারা বিধ্বস্ত হিরোশিমার হৃদপিণ্ড থেকে ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’, ‘আর হিরোশিমা-নাগাসাকি নয়, শান্তি চাই’ শ্লোগান তুলে যে ব্যাপক শান্তি আন্দোলনের সূচনা ঘটে তার উদ্যোক্তা ছিলেন শান্তিবাদী শ্রমিকনেতা, সাহিত্যিক কাগাওয়া তোমোহিকো, শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও, প্রথম জাপানি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী ড. য়ুকাওয়া হিদেও, তানাকা মাসাআকি প্রমুখ। প্রথম এশিয়ান কংগ্রেস বা শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় হিরোশিমায় ১৯৫২ সালে। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল। বন্ধুবর শিমোনাকার আমন্ত্রণে চার বছর পর জাপানে পুনরাগমন করেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, নিকটপ্রাচ্য, আরব দেশসমূহ থেকেও শতাধিক শান্তিবাদী নেতা ও কর্মী অংশগ্রহণ করেছিলেন। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন লন্ডনস্থ ওয়ার্ল্ড মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড ফেডারেল গভার্ণমেন্ট ( World Movement for World Federal Government (WMWFG)-এর চেয়ারম্যান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী স্যার জন বোয়িড ওয়ার। এই সম্মেলনে বিচারপতি পাল টোকিও ট্রাইব্যুনাল এবং হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলার জন্য আমেরিকা, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসসহ শ্বেতাঙ্গশক্তির তীব্র সমালোচনা করেন। হিরোশিমা শান্তি জাদুঘরের সেনোটাফ বা স্মারকস্তম্ভে লিখিত বাণী সম্পর্কে গভীর সংশয় এবং দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন। বাণীটিতে লিখিত আছে: ‘নির্বিঘ্ন শান্তিতে তোমরা ঘুমিয়ে থাকো, (বোমা ফেলার মতো) ভুল পুনর্বার ঘটতে দেব না।’ বিচারপতি পাল এর অর্থ সম্পর্কে জাপানি বন্ধুদের কাছে বলেন, বোমা জাপানিরা ফেলেনি, যারা ফেলেছে তাদের হাত এখনো কলুষিত, তারা এখনো কৃতকর্মের অপরাধ স্বীকার করেনি। স্বজ্ঞানে কৃতকর্ম তো ভুল হিসেবে গণ্য হতে পারে না! ভুল পুনর্বার ঘটতে না দেয়ার অর্থ এই কৃতকর্মের দায়ভার জাপানিদের উপরই বর্তায়। এটা কী সঠিক হলো?
হিরোশিমার হোনশোজি বৌদ্ধমন্দির চত্বরে ড.পাল লিখিত বাণীর প্রস্তরফলক
নীতির প্রতি অবিচল, ন্যায়দণ্ডের মূর্তপ্রতীক, বিচারপতি পাল জাপানিদেরও কঠোর সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তিনি দেখেন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে। জনজীবন মার্কিনী সস্তা সংস্কৃতিতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে যা জাপানি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব দেখে বিস্মিত ড. পাল একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন এক সংবর্ধনা সভায়: ‘জাপানিরা জাপানে ফিরে এসো।’ তিনি তরুণপ্রজন্ম ও নারীসমাজের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্পর্কে দুটি মূল্যবান প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। ৪৫ দিনের সফরকালে হিরোশিমা, কিয়োতো, টোকিও, ওয়াসেদা, মেইজি, নিহোন, হোসেই প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টোকিও বার অ্যাসোসিয়েশনের সংবর্ধনা গ্রহণ এবং বক্তৃতা করেন। নিহোন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত ডিলিট প্রদান করে। বক্তৃতায় তিনি বারংবার আহবান জানিয়েছেন তাঁর গবেষণালদ্ধ রায়টি যাতে জাপানিরা পড়েন এবং গবেষণা করে ঐতিহ্যকে না ভুলে গিয়ে ভবিষ্যৎ সুখী-সমৃদ্ধ-শান্তিময় জাপানকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। শিশুদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস পড়ানোর জন্য একাধিকবার অনুরোধ জানান। বস্তুত, জাপানের জাতীয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও পর্যন্ত সত্যিকার, সঠিক ইতিহাসটি পড়ানো হয় না। বিতর্কিত বিষয় পড়ানো হচ্ছে যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, মিত্রশক্তি প্রধান আমেরিকা, বৃটেন কতখানি দোষী, আর জাপানইবা কতখানি দায়ী--এসব সম্পর্কে যুদ্ধোত্তর প্রজন্মগুলো কিছুই জানে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমেরিকার ন্যায়-অন্যায়ের সমালোচনা বা বাদপ্রতিবাদ করার শক্তি জাপানের নেই।
টোকিওর ইয়াসুকুনি জিনজা মন্দিরে ড.পালের স্মৃতিফলকের সামনে জাপানিদের ভীড়
সচেতন জাপানিরা বিচারপতি পালকে যে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধাভক্তি করেন তার প্রমাণ ১৯৯৭ সালে টোকিওতে অবস্থিত বিতর্কিত জাতীয় শিন্তোও ধর্মীয় ‘ইয়াসুনি জিনজা’ মন্দির এবং প্রাচীন রাজধানী কিয়োতো শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ‘রিয়োজেন গোকোকু জিনজা’ মন্দিরের প্রাঙ্গণে একই নকশার একটি করে দুটি পাথরের স্মৃতিফলক স্থাপনের মধ্যে পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে ড. পালের জাপানি বন্ধু দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জনকারী কিশি নোবুসুকের নাতি আবে শিনজোও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কলকাতায় গিয়ে বিচারপতি পালের একমাত্র পুত্র আইনজীবী প্রশান্তকুমার পালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর পিতার রায়ের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এটাও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা কিন্তু জাপানে ফিরে আসার পরই রহস্যজনকভাবে তাঁকে প্রধান মন্ত্রীর পদ হারাতে হয়। তবে এটা ঠিক যে, জাপানিরা স্পষ্টভাষী নয়, তারা কাজে বিশ্বাসী। কাজের মধ্য দিয়ে তারা তাদের মনোভাব প্রকাশ করে থাকেন। জাপানি জাতির ‘ইনোচি নো অন্জিন’ বা ‘জীবনদাতা’ বলে বিবেচিত বিচারপতি পালের এই স্মৃতিফলক স্থাপনের বিষয়টি তেমনি একটি কাজ। এর মাধ্যমে চিরশান্তিবাদী মানবপ্রেমী রবীন্দ্রভক্ত ড. পালের জীবন, কর্ম ও সাধনা সম্পর্কে জানার ও বোঝার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জাপানি জাতিই নয়, সমগ্র বিশ্বের বর্তমান এবং অনাগত প্রজন্মের জন্য একটি মাইলফলক বলতেই হবে। এতে করে যে ব্যাপক একটি সাড়া পড়েছে তা পরিলক্ষিত হয় বিচারপতি পাল সম্পর্কিত জাপানি ভাষার অনেক ইন্টারনেট ওয়েবসাইটে। ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই স্মৃতিফলক দুটি স্থাপনের পেছনে সুদূরপ্রসারী একটি কূটনীতিও যে কাজ করেছে, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৫২ সালে জাপান সফরকালে হিরোশিমা শান্তি জাদুঘরের নিকটস্থ কোমাচি হোনশোজি বৌদ্ধমন্দিরের প্রধান পুরোহিত কাকেই ইয়োশিআকির অনুরোধে একটি বাণী লিখে দেন বাংলা ও সংস্কৃতভাষায় ড. পাল। ৬ই আগস্ট ১৯৪৫ সালের সকাল ৮:১৫ মিনিটে নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার আঘাতে এই মন্দিরসহ আরও লক্ষাধিক নিহত মানুষের আত্মার শান্তি কামনায় তিনি কাগজে যে বাণীটি লিপিবদ্ধ করেন সেটি নিম্নরূপ:
নির্যাতিত এশিয়ার মুক্তিযজ্ঞে
মন্ত্রদীক্ষিত স্বর্গত আত্মার
শান্তি কামনায়
--রাধাবিনোদ পাল
৬ নভেম্বর, ১৯৫২
হোনশোজি মন্দির চত্বরে পাথুরে খোদাইকৃত স্মারক ফলকটি দাঁড়িয়ে আছে নীরবে বিগত সাত দশক ধরে। প্রতি বছর অনেক বাঙালি ও ভারতীয় হিরোশিমা শান্তি জাদুঘর পরিদর্শনে যান কিন্তু জানেন না এই ফলকটির কথা। ২০১০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ষেখ হাসিনা হিরোশিমা শান্তি জাদুঘর পরিদর্শন করেছিলেন, কিন্তু তিনিও জানতেন না তার দেশে জন্ম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বীর বাঙালি আইনজ্ঞ বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের একটি স্মৃতিফলক রয়েছে জাদুঘরের নিকটবর্তী শহরে।
হিরোশিমা শান্তি আন্দোলনকে ভারত পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিলেন বিচারপতি পাল। ১৯৫৫ সালে কলকাতা ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট মুভমেন্ট সংস্থার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর সহকর্মীরা ছিলেন তখনকার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ যথাক্রমে অধ্যাপক ড. ত্রিগুণা সেন, প্রধান বিচারপতি ড. বি. মালিক, অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ড. কালীদাস নাগ প্রমুখ। ১৯৬২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত শান্তিসম্মেলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৬৬ সালে শেষবারের মতো জাপানে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন শোওয়া সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক পদক ‘পার্পল রিবন’ গ্রহণ করার জন্য। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে এই কর্মবীর মানুষটি কলকাতার বাসভবনে পরলোক গমন করেন।