একবার বললেন, মিয়ারা তোমরা কি করো? তোমাদের এই বয়সে আমি পাশের বাড়ির দুইটা মেয়ের সাথে প্রেম করতাম।
Published : 30 Mar 2025, 04:03 PM
আমি যখন ঢাকা কলেজ ভর্তি হই, ১৯৬৫ সালে, আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন জালালুদ্দিন আহমেদ। তখন ঢাকা কলেজ ছিল তার সুনামের শীর্ষে। প্রতিবছর গ্রাম গঞ্জ মফস্বলের সব ভালো ছাত্ররা দলবেঁধে ঢাকা কলেজ আসতো। আবার ঢাকা শহরের যেসব ভালো স্কুল পাশ করা ছাত্ররা এবং বনেদি ঘরের ছেলেরা সাধারণত যেত নটরডম কলেজ। এই দুই কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের প্রতিযোগিতা কলেজ ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও গড়াতো। সে সময় এই দুইটি কলেজ ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকা একচেটিয়া দখল করে রাখতো।
শিক্ষক
ঢাকা কলেজের শিক্ষকেরাই ছিলেন কলেজের প্রাণবিন্দু। তারা শুধু ভালো শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন সর্বতোভাবে শ্রদ্ধাভাজন ব্যাক্তিত্ব। তাদের কয়জনের কথা বিশেষভাবে বলতেই হবে|
মোহাম্মদ নোমান স্যার আমাদেরকে ইংরেজি পড়াতেন। দারুন ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষক। তিনি যখন ডায়াসে উঠে পড়ানো শুরু করতেন, সবাই মুগ্ধ হয়ে তার পড়ানো শুনতেন। দারুন সুন্দর উচারণে ইংরেজি পড়াতেন।
প্রিন্সিপাল জালালুদ্দিনও আমাদেরকে ইংরেজি পড়াতেন। ক্লাস রুমের বাইরে তিনি ছিলেন লাঠি হাতে প্রশাসক, কলেজের নিয়ম শৃঙ্ঘলা রক্ষার সব দায়িত্ব একাই কাঁধে নিয়ে তিনি সারাক্ষণ কলেজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত টহল দিতেন। ছাত্ররা তাকে ভীষণ ভয় করতো। কিন্তু ক্লাস রুমে তিনি ছিলেন ভিন্ন এক লোক। দারুন মজা করে ইংরেজি পড়াতেন, সাথে থাকতো প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক গল্প। একবার বললেন, মিয়ারা তোমরা কি করো? তোমাদের এই বয়সে আমি পাশের বাড়ির দুইটা মেয়ের সাথে প্রেম করতাম। আরেকবার, ইংরেজি কি একটা গল্পে মদ পান করার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তার জিহ্বাকে ঠোঁটের দুপাশে এমনভাবে চুক চুক করে ঘুরালেন, তা দেখতে ছিল খুব মজার। কিন্তু আমরা উপভোগ করলেও, বেশি হাসতে বা প্রতিক্রিয়া দেখতে পারতাম না, তাকে নিয়ে এত ভয় ছিল ছাত্রদের মনে।
আমাদের অংকের প্রধান শিক্ষক ছিলেন সিরাজুল ইসলাম স্যার। স্যার জটিল অঙ্ক অনেক সহজ করে বুঝাতেন, তার ছাত্রদের কাছে তা ছিল খুব তৃপ্তির। কিন্তু আমাদের এক বন্ধু- তার অসুবিধা হতো অঙ্ক বুঝতে। সে ধানমন্ডিতে থাকে - ধনি পরিবারের সন্তান, একদিন সিরাজ স্যারকে অনুরোধ জানালো, তার বাবা চান স্যার ওর বাড়িতে গিয়ে ওকে প্রাইভেট পড়াবেন। তার বাবা বলেছেন তিনি গাড়ি পাঠাবেন স্যারকে আনতে আবার পড়া শেষে তাকে পৌঁছিয়ে দেবেন স্যারের বাড়িতে। আর অন্য সব বিষয়ে তার বাবাই সিরাজ স্যারের সাথে সরাসরি কথা বলবেন। সিরাজ স্যার হাসলেন, বললেন - প্রাইভেট পড়াতে হবে কেন? তুমি আমার রুমে চলে আসবে যখন আমার ক্লাস থাকবে না। আর ছুটির দিনে একটা ফোন করে আমার আজিমপুর কলোনির বাসায় চলে এসো, আমি তোমাকে সাহায্য করবো। কথাগুলো আমার বন্ধুই বলেছিলো আমাকে, আমাদের সিরাজ স্যারকে নিয়ে এই কথাগুলো এতদিন পরেও কি ভুলে যাওয়া যায়?
আর আজকের সিরাজ স্যারেরা পথে ঘাটে সাইন বোর্ড টানিয়ে কোচিং সেন্টার খুলে বসে আছেন!
বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান ছিলেন আমাদের বাংলার শিক্ষক। স্যার ক্লাসে পড়াবার চেয়েও গল্প করতেই বেশি পছন্দ করতেন। একদিন ক্লাসে ছাত্রদের সাদামাটা পোশাক দেখে খুব সমালোচনা করলেন, আপনারা সবাই দেখি এই বয়সেই বুড়া হয়ে গেছেন, গিয়ে নিউ মার্কেট থেকে লাল নীল নানা ডিজাইন করা কাপড়ের শার্ট সিলাবেন, দাম দেশি হলে চকচকে লুঙ্গির কাপড় কিনে শার্ট বানাবেন। স্যার ছাত্রদেরকে আপনি করে বলতেন। প্রথম বর্ষে যারা শওকত ওসমানের টিউটোরিয়াল গ্রুপে পড়লো, তারা খুবই খুশি - আমিও সেই দলে। ভাবলাম, স্যার থেকে বাংলা রচনা শিখে, দারুন একজন কেউ বনে যাবো। প্রথম দিনের শুরুতেই স্যার দারুন উৎসাহিত করলেন, ক্লাসের শেষ দিকে বললেন, এই ক্লাসে বাংলা জানেন না এমন কেউ আছেন, হাত তোলেন। কেউও হাত তুললো না। স্যার বললেন, সবাই যখন বাংলা জানেন, টিউটোরিয়ালের কোনো প্রয়োজন নেই। কিছ অসুবিধা হলে আমার অফিস রুমে চলে আসবেন।
ড. আশরাফ সিদ্দিকীও ঢাকা কলেজ বাংলা পড়াতেন। স্যার ছিলেন ফোকলোরের বা লোকসাহিত্য বিশেষজ্ঞ। শান্তি নিকেতনে পড়ালেখা করেছেন, দারুন রবীন্দ্রভক্ত। ক্লাসে রবীন্দ্রভক্ত হলেও, পত্র পত্রিকায় যে সব রবীন্দ্রবিরোধী বিবৃতি বের হতো, তার সবগুলোতেই আশরাফ স্যারের নাম থাকতো। তখন গভর্নর মোনেম খান এক দল বুদ্ধিজীবীদেরকে দিয়ে প্রতিনিয়ত রবীন্দ্র সংগীতের বিরোধিতা করে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে প্ররোচিত করতেন। আশরাফ স্যারের এই স্ববিরোধিতার জন্য ছাত্ররা তার উপর খুব অসন্তুষ্ট ছিল। তবে তখন এইসব নিয়ে কলেজ বা ক্লাসে হৈ চৈ করার নিয়ম ছিল না, ঢাকা কলেজতে তো নয়ই!
আরেকজন শিক্ষক রসায়ন বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আলী, একদম মাটির মানুষ। একদিন আমার রুমমেট রায়হান এসে বললো, তাড়াতাড়ি কাপড় পড়। মোহাম্মদ আলী স্যারের বাসায় যেতে হবে, সব ছাত্ররা দলবেঁধে যাচ্ছে। রায়হানকে কারণ জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, মোহাম্মদ আলী স্যার এবার ঢাকা বোর্ডের রাসায়ণের হেড এক্সামিনার বা প্রধান পরীক্ষক। তার থেকে 'সাজেশন' নেয়ার জন্য ছাত্ররা সব যাচ্ছে। স্যার থাকেন কাঁঠাল বাগান সরকারি কোয়ার্টারে। বাসে ঝুলে আমরাও গেলাম। স্যারের বাড়ির দরজার সামনে বিরাট লম্বা লাইন। স্যার প্রতিবার দরজা খুলে তার বাইরের রুমে ছাত্রদেরকে ঢুকাচ্ছেন, রুম পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত। একসময় আমার পালাও এলো, দারুন উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছি - প্রধান পরীক্ষকের 'সাজেশনের' জন্য। স্যার আমাদের পাঠ্য ললিতমোহনের রসায়ন বইটা খুলে সাজেশন' দিতে থাকলেন। মোটামুটি পিরিয়ডিক টেবিলের প্রত্যেকটা রাসায়নিক পদার্থ এবং পুরা সিলেবাসটা মোহাম্মদ আলী স্যারের সাজেশনে পড়ে গেলো। দারুন হতাশ হয়ে হোস্টেলে ফিরে আসলাম। এখন যখন ভাবি মোহাম্মদ আলী স্যার তার বাড়িতে যাওয়া ছাত্রদের সাথে অভদ্র হয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে রাখেননি, আবার নিজের নীতির সাথেও এক চুলও আপোষ করেননি, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
রাজনীতি
প্রিন্সিপাল জালালুদ্দিন ছিলেন দারুন একজন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ। তিনি ঢাকা কলেজের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সবসময় সক্রিয় থাকতেন। তখন আয়ুব খানের সময়। জালালউদ্দিন স্যার ছিলেন আয়ুব খানের 'তমঘায়ে পাকিস্তান' খেতাবধারী লোক। তার আরেকটা পরিচয় তিনি আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শশুর। মেয়েকে রাজনীতিবিদের সাথে বিয়ে দিলেও, তিনি ছিলেন দারুন রাজনীতিবিমুখ মানুষ। তার সময়ে ঢাকা কলেজ ছাত্ররা রাজনীতির 'র'ও মুখে আনতে পারতো না। কলেজ ও হোস্টেল সংসদ্গুলোর নির্বাচন হতো অরাজনৈতিকভাবে। ঢাকা কলেজ দক্ষিণ হোস্টেলে ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও মজিদুর রহমান বিশ্বাস দাঁড়ালেন সহসভাপতি পদে, একজন ছাত্র লীগের অন্যজন ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক। ইকবাল সোবহান চৌধুরী হেরে গেলেন। নির্বাচন ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে সবসময় প্রতারিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সূর্য সেন হলের সহ্যসভাপতি পদে হারলেন, ফেনীতে যতবারই সংসদের নির্বাচনে প্রাথী হয়েছিলেন প্রতিবারই হেরেছেন। অবশ্য সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে তিনি প্রতিবারই জয়লাভ করেছেন।
রাজনীতি করার অনুমতি না থাকলেও তখনও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মাঝে ভিতরে ভিতরে রাজনীতি চলতো, বিশেষ করে যারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন তাদের মাঝে। শেখ শহিদুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে, থাকতেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেই। ঢাকা কলেজ বিএসসি পড়তেন। তিনি ঠিক করলেন ঢাকা কলেজে ছাত্র লীগের কমিটি করবেন। আমরা সবাই একদিন বিকেলে কলেজ ছুটির পর ক্যান্টিনে গিয়ে বসলাম। শহিদ ভাই চানাচুর প্যাটিস ইত্যাদি কিনে এনেছেন। প্যাকেটগুলো খুলে সবে আমরা গোল হয়ে বসেছি। এমন সময় জালালুদ্দিন স্যার ক্যান্টিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, ক্যাডা এখানে মিটিং করে? তার কণ্ঠ শুনার সাথে সাথে সবাইর দৌড়, যে যেদিকে পারে। আমি গিয়ে ক্রিকেট মাঠে দাঁড়িয়ে গেলাম, অন্য ছাত্ররা যেখান ফিল্ডিং করছে। ছাত্র লীগের কমিটি সে বছর আর করা হয়নি।
যারা তখন ঢাকা কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন আমাদের বন্ধু মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, মাহফুজুল্লাহ ও হেলালুদ্দীন। তাদের ভাগ্যে প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন আরো বেশি দুর্গতি ঘটালেন। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য তাদেরকে ঢাকা কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হলো। পরে তারা জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে তাদের এইচ-এস-সি শেষ করে ।
সেই ঢাকা কলেজ। একবার সংবাদপত্রে দেখলাম, দক্ষিণ হোস্টেল থেকে বন্দুক পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। ছাত্ররা রাস্তায় গিয়ে মারামারি করছে। আমাদের স্মৃতিময় ঢাকা কলেজের সুন্দর দিনগুলো কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে?