Published : 01 May 2025, 06:03 PM
তুলনায় তার বড্ড আপত্তি! ইন্টার মিলান ম্যাচের আগেও লামিনে ইয়ামাল বলেছিলেন, লিওনেল মেসির সঙ্গে তার তুলনা মানায় না, ঠিকও নয়; কেননা, মেসি তো ‘ইতিহাসের সেরা।’ কিন্তু ইয়ামালই যে তুলনার আলোচনা থামতে দিচ্ছেন না! মেসিকে সেরা মেনে নেওয়ার পর মাঠে নেমে তিনি নিজেই যা করলেন, ইন্টারের ওপর যেভাবে ছড়ি ঘোরালেন, ঘোরলাগা জাদুকরী মুহূর্ত উপহার দিলেন, তা যেন ১৭ বছর বয়সের একজন ফুটবলার কেবল কল্পনাই করতে পারেন।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালে বুধবার রাতে নাটকীয়তায় ভরা বার্সেলোনা বনাম ইন্টার মিলান লড়াইয়ে আলো ছড়ান অনেকে। রোমাঞ্চের নানা বাঁক পেরুনো ম্যাচে উত্তেজনার পারদ উঠেছিল তুঙ্গে; কিন্তু সবার মাঝ থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন ইয়ামাল। সব আলো যেন তিনি কেড়ে নিয়েছেন একাই।
তাইতো শুধু আর্জেন্টাইন মহাতারকার সঙ্গেই কেবল তার তুলনা হচ্ছে না, গত কয়েক দশকের সব তারকা ফুটবলারের চেয়েই ইয়ামালকে যেন এগিয়ে রাখতে চাইছেন কেউ কেউ। অথচ তার বয়স এখনও ১৮ স্পর্শ করেনি, যার চোখমুখে এখনও লেগে আছে কিশোরের ছাপ। যে কিশোর ‘সিনিয়র’ ভয়চেখ স্ট্যান্সনির কথা না শুনে ‘গো’ ধরে চুলের স্টাইল করেন ইচ্ছেমতো!
বার্সেলোনার মাঠে এদিনের ৩-৩ গোলের অমীমাংসিত প্রথম লেগের ধ্রুপদী লড়াইয়ে নিশ্চিতভাবে মাঠের সেরা পারফর্মার ইন্টারের ডেনজেল ডামফ্রিস। দলের তিনটি গোলেই জড়িয়ে এই ডাচ ডিফেন্ডারের নাম; জোড়া গোল করে ও একটি করিয়ে ম্যান অব দা ম্যাচ নির্বাচিত হন। কিন্তু ফুটবল বিশ্বের প্রায় সবখানে খবরের শিরোনামে ২৯ বছর বয়সী ডামফ্রিস নন, তার হাঁটুর বয়সী ইয়ামাল। পিছিয়ে পড়ার পর যার অসাধারণ নৈপুণ্যে, দৃষ্টিনন্দন গোলে লড়াইয়ে ফেরে বার্সেলোনা। কাতালান ক্লাবটির জার্সিতে শততম ম্যাচে এটা ছিল তার ২২তম গোল।
মাঠের জাদুকরী অনেক মুহর্ত, এই অল্প বয়সে দলীয় ফুটবলে তার অভূতপূর্ব আধিপত্য, প্রতি মুহূর্তে প্রতিপক্ষের রক্ষণে প্রবল ঝাঁকুনি দেওয়ার, কাঁপন ধরানোর সামর্থ্য-এসব তো আছেই, সঙ্গে পরিসংখ্যানের এই চমৎকার চিত্রই গত দুই যুগে ফুটবল বিশ্বে দাপট দেখানো মেসি-রোনালদোর সঙ্গে ইয়ামালকে সরাসরি তুলে দিয়েছে তুলনার মঞ্চে।
আজকের মহাতারকা, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ও দুটি কোপা আমেরিকা জয়ী মেসি ১৭ বছর বয়সে ৯ ম্যাচ খেলে কেবল একটি গোলই করতে পেরেছিলেন আর ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো ১৮ বছর পূর্ণ করার আগে ১৯ ম্যাচ খেলে করেছিলেন পাঁচ গোল। সেখানে ইয়ামাল ছুটছেন অবিশ্বাস্য ছন্দে আর অশ্ববেগে। ইন্টারের বিপক্ষে যেমন ২১ মিনিটের মধ্যে দুই গোল হজম করে ভীষণ চাপে দিশাহীন হয়ে পড়া দলকে পথে ফেরাতে এক মাস্টারক্লাস পারফরম্যান্স উপহার দিলেন তিনি।
ব্যবধান কমানো চোখধাঁধানো গোলটি ২৪তম মিনিটে করেন ইয়ামাল। ডান দিকে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে বক্সে ঢুকে কয়েকজন খেলোয়াড়ের মাঝ দিয়ে বাঁ পায়ে শট নেন স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড, বল দূরের পোস্টে লেগে জালে জড়ায়, তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না গোলরক্ষক ইয়ান সমেরের। ফুটবলপ্রেমীরাও দেখল মুগ্ধ নয়নে। এমন ঝলক মেসিও দেখাতেন বাঁ পায়েই।
২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সেমি-ফাইনালেও এমন নজরকাড়া একটি গোল করেছিলেন ইতোমধ্যে বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের একজন হয়ে ওঠা ইয়ামাল। প্রথমার্ধে বার্সেলোনার এই তরুণ সেনসেশনের পারফরম্যান্সে টিএনটি স্পোর্টসের বিশেষজ্ঞ অ্যালাই ম্যাককয়েস্ট এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, বিরতিতে খেলোয়াড়রা মাঠ ছাড়ার সময় তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না, জীবনে আগে কখনও আমি ৪৫ মিনিটে কোনো একজনের এমন পারফরম্যান্স দেখেছি। অবিশ্বাস্য।”
প্রতিপক্ষ কোচ সিমোনে ইনজাগির কণ্ঠে ইয়ামালকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের মাত্রা আরও বেশি। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, “লামিনে এমন এক প্রতিভা যা ৫০ বছরে একবারই দেখা যায় এবং তাকে কাছ থেকে দেখতে পেরে আমি আসলেই আনন্দিত, মুগ্ধ।”
“সে আমাদের জন্য অনেক সমস্যা তৈরি করেছে, কারণ আমরা তাকে আটকাতে দুজনকে পাহারায় রাখার পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু সেটাও যথেষ্ট ছিল না।”
বার্সেলোনা কোচ তো সবসময়ই ইয়ামালের প্রশংসা করে আসছেন। তাকে দলে পেয়ে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলেন হান্সি ফ্লিক।
“সে স্পেশাল, সে জিনিয়াস। বড় ম্যাচে সবসময় নিজেকে মেলে ধরে। সিমোনে যেমনটা বলেছেন যে, প্রতি ৫০ বছরে এমন একজনই আসে, সেটা বার্সেলোনার জন্য হওয়ায় আমি খুশি।”
বিবিসি বিশেষজ্ঞ স্টেফেন ওয়ার্নক ইয়ামালকে দেখছেন ‘ভবিষ্যৎ ব্যালন দ’র বিজয়ী হিসেবে।‘
নিশ্চিতভাবেই এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর লড়াইগুলোর একটি এই বার্সেলোনা-ইন্টার ম্যাচটি, যা সান সিরোর ফিরতি লেগ নিয়ে সবাইকে আরও বেশি রোমাঞ্চিত করে তুলেছে।
ম্যাচে ইয়ামাল কী করেছেন?
ম্যাচ শুরুর আগে তরুণ এই তারকাকে ঘিরে কিছু সময়ের জন্য হলেও শঙ্কা ঘিরে ধরে। ওয়ার্ম-আপের সময় কুঁচকিতে কিছুটা সমস্যা অনুভব করেন তিনি এবং দলের সবার কপালে ভাঁজ ফেলে টানেলের দিকে চলে যান। তাতে শঙ্কার মেঘ ঘণিভূত হয়, প্রশ্ন জাগে খেলতে পারবেন তো ইয়ামাল? তবে, সব আশঙ্কা উড়িয়ে শুরুর একাদশেই মাঠে নামেন তিনি।
ইন্টার দুই গোলে এগিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাঠে তার তেমন কোনো প্রভাব অবশ্য চোখে পড়েনি। এরপরই দুজনের পাহারায় থাকা ইয়ামাল জ্বলে ওঠেন, প্রতিপক্ষের কয়েকজনকে ফাঁকি দিয়ে দূরের পোস্ট দিয়ে করেন চমৎকার গোলটি। ওই গোলে ফুটে ওঠে কঠিন পরিস্থিতিকে তার সহজ করে তোলার সামর্থ্য ও আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাস।
কিছুক্ষণের মধ্যে তার পায়ে দেখা মেলে আরেক জাদুকরী মুহূর্ত; বাইলাইনে আরও বেশি ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে শট নেন তিনি, যা কোনোমতে একহাত দিয়ে আটকান ইন্টার গোলকিপার সমের।
বিরতির আগে দলগত দারুণ এক আক্রমণে সমতা টানেন ফেররান তরেস। যদিও ৬৩তম মিনিটে ডামফ্রিসের দারুণ হেডে আবার এগিয়ে যায় ইন্টার। অবশ্য এবার ব্যবধান দুই মিনিটও ধরে রাখতে পারেনি ইতালিয়ান ক্লাবটি। ২৫ গজ দূর থেকে রাফিনিয়ার বুলেট গতির শট ক্রসবারে বাধা পেয়ে বল সমেরের পিঠে লেগে জালে জড়ায়।
পরে হেনরিখ মিখিতারিয়ান জালে বল পাঠালে আবার এগিয়ে যাওয়ার উদযাপন করে সফরকারীরা, তবে তাদের সেই উচ্ছ্বাস থেমে যায় ভিএআর সিদ্ধান্তে; কিঞ্চিৎ ব্যবধানে অফসাইডে ছিলেন তিনি।
এরপর মেলেনি আর কোনো জালের দেখা। তবে শেষটায় সবকিছু বদলে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেন ইয়ামাল, ভাগ্যকে এবারও পাশে পাননি তিনি। নির্ধারিত সময়ের তিন মিনিট বাকি থাকতে তার শট বাধা পায় ক্রসবারে। এক গোল পাওয়ার ম্যাচে দুইবার ক্রসবারের বাধায় বঞ্চিত হলেন। তবে প্রাপ্তির আনন্দও কম নয় তার।
ইয়ামালের পায়ে লুটিয়ে পড়ছে রেকর্ড
এই বয়সে ধারাবাহিকভাবে মাঠে যা কিছু করে চলেছেন ইয়ামাল, তা যেন বিশ্বাস করাই মুশকিল।
বার্সেলোনার জার্সিতে ১০০টি ম্যাচ খেলে ২২টি গোল করলেন। আর জাতীয় দলের হয়ে ১৯ ম্যাচে তার গোল চারটি। পাশাপাশি ২৭টি অ্যাসিস্টও করেছেন, এর মধ্যে দুটি গত শনিবার কোপা দেল রের ফাইনালে; রেয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ৩-২ গোলে জয়ের ম্যাচে।
যেখানে মেসি ও রোনালদোর ১৮ বছর বয়সের আগে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেকই হয়নি, সেখানে ইয়ামাল ১৭তম জন্মদিনের পরদিন ২০২৪ ইউরোর ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন। এবং ওই টুর্নামেন্টে ছিলেন স্পেন দলের সেরা পারফরমারদের একজন।
১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মেসি একটি গোলই কেবল করতে পেরেছিলেন, কোনো অ্যাসিস্ট ছিল না। আর রোনালদো করেছিলেন পাঁচটি গোল ও চারটি অ্যাসিস্ট। পরিসংখ্যানের এই পাতায় ইয়ামালের ধারে-কাছেও নেই ফুটবলের এই দুই কিংবদন্তি।
বার্সেলোনার জার্সিতে লা লিগার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের রেকর্ডটি ইয়ামালের নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে (১৫ বছর বয়সে) এবং স্পেনের শীর্ষ লিগে যেকোনো দলের হিসেবেই সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা ও অ্যাসিস্ট করা খেলোয়াড়ও তিনি।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে শুরুর একাদশে খেলা, নকআউট পর্বের ম্যাচে সবচেয়ে কম বয়সে গোলের রেকর্ডও আছে ইয়ামালের নামের পাশে; কোয়ার্টার-ফাইনাল ও এখন সেমি-ফাইনালেও।
জাতীয় দলেও এই রেকর্ডগুলো আগেই নিজের করে নিয়েছেন ইয়ামাল; স্পেনের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ও গোলদাতা এবং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সবচেয়ে কম বয়সের গোলদাতা তিনি।
মেসির সঙ্গে তুলনা এড়িয়ে যেতে পারছেন না ইয়ামাল
আগামী ১৩ জুলাই ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হবে ইয়ামালের। এই বয়সে পূর্বে খুব কম খেলোয়াড়ই তার মতো ফুটবলের আঙিনায় প্রভাব ফেলতে পেরেছেন।
বার্সেলোনার ইতিহাসের সেরা ফুটবলার এবং সোনালী যুগের অসংখ্য সাফল্যের নায়ক মেসি তার জাতীয় দলেরও প্রাণভোমরা। তাকে ঘিরেই গত কয়েক বছরে সাফল্যের শীর্ষে উঠে বসেছে আর্জেন্টিনা, টানা জিতেছেন কোপা আমেরিকা-বিশ্বকাপ-কোপা আমেরিকা। তর্কসাপেক্ষে অনেকেই তাকে ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় মনে করেন। তার মতো এক বিশ্বজয়ীর সঙ্গেই তুলনা শুরু হয়ে গেছে ইয়ামালের।
দুজনের উঠে আসার আঙিনা একই- বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়া। রাইট উইং ধরে দুজনের খেলার ধরণও অনেকটা একইরকম। ইয়ামালের অনেক গোল আছে, যা দেখলে মেসির চোখধাঁধানো গোলগুলোকে মনে করিয়ে দেয়।
তবে খেলার কৌশলে যত সাদৃশ্যই থাকুক, নিজে যতই সামর্থ্যবান হন না কেন, মেসির সঙ্গে কোনোভাবেই নিজের তুলনা পছন্দ করেন না ইয়ামাল। ম্যাচের আগে যেমন মেসিকে ‘ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়’ মন্তব্য করে ইয়ামাল বলেন, “তার সঙ্গে আমি আমার তুলনা করি না, কারণ আমি কারোর সঙ্গেই নিজের তুলনা করি না-মেসির সঙ্গে তো আরও কম।”
তবে, ১৭ বছর বয়সে মেসি কেবলই খুব, খুব প্রতিভাবান এক খেলোয়াড় ছিলেন, ইয়ামালের মতো সময়ের সেরাদের একজন হয়ে ওঠেননি।
সবকিছুর পরেও এই তুলনায় কোনো যৌক্তিকতায় দেখেন না ইয়ামাল।
“আমার মনে হয় না, এই তুলনার কোনো অর্থ আছে, মেসির সঙ্গে তো প্রশ্নই ওঠে না-আমি নিজেকে উপভোগ করব এবং নিজের মতোই খেলে যাব।”
ইয়ামাল নিজে না চাইলেও যেভাবে তিনি ছুটে চলেছেন, তাতে সামনের দিনগুলোয় তাকে নিয়ে স্তুতির জোয়ার হয়তো কেবলই বাড়বে। সেই সঙ্গে মেসি-রোনালদোদের সঙ্গে তার তুলনাও পাবে নতুন নতুন মাত্রা।
ফুটবলের জনপ্রিয় সাংবাদিক ফাব্রিসিও রোমানো যেমন রোনালদো ও মেসির এই বয়সের পরিসংখ্যান এবং তার নিচে ইয়ামালের চমক জাগানো সংখ্যাগুলো তুলে ধরে লিখেছেন, “লামিনে এসেছেন অন্য গ্রহ থেকে।”
‘অন্য গ্রহ থেকে আসা’, শতবার শোনা এই কথাটি এতদিন বলা হতো কেবল মেসিকে নিয়ে। ইয়ামালকে নিয়ে বলা হচ্ছে এখন। আগামীতে বলা হলে, চাইলেও তো তখন তুলনার স্রোত আটকাতে পারবেন না ইয়ামাল!