Published : 30 Apr 2025, 01:52 AM
পুলিশ সপ্তাহ ঘিরে বাহিনীর ভেঙে যাওয়া মনোবল ফেরানো নিয়ে ফের কথা উঠেছে; এর মধ্যে সংস্কার নিয়ে ‘হতাশা’, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট বা ছাত্রদের কোনো আন্দোলনের ঘটনায় ‘কার্যকর’ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘ভয়ে’ থাকার বিষয়টি আছে।
অভ্যুত্থানে হত্যার অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় বাহিনীতে ‘আতঙ্ক’ তৈরি হওয়ার কথা এসেছে। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ প্রস্তুত কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ও অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হামলা-হত্যার শিকার হওয়ার প্রেক্ষাপটে পুলিশের ভেঙে পড়া মনোবল এখনো ফেরেনি বলছেন কর্মকর্তারা।
পুলিশের মনোবল চাঙ্গা করতে ইতোমধ্যেই নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ, বদল এসেছে পুলিশের লোগোতে। পরিবর্তন আসছে পোশাকেও। তাতেও যে পুলিশের মনোবল ফেরেনি তা স্পষ্ট হয়েছে আইজিপির কথায়।
পুলিশ সপ্তাহ শুরুর আগের দিন সোমবার পুলিশের মহাপরির্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, পুলিশ একটা বড় ‘ট্রমার’ মধ্য দিয়ে গেছে। তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যদের সেই জায়গা থেকে বের করে আনতে এবং জনগণের আস্থা ফেরাতে।
পাশাপাশি অভ্যুত্থানের সময় হত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের দায় নিরূপণের কাজ চলার কথাও বলেছেন তিনি।
মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারাও বলছেন, তারা মনোবল হারিয়েছেন। তাদের দায়িত্ব দেশের নাগরিক ও সম্পদ রক্ষা করা, কিন্তু তাদের কে রক্ষা করবে সেই নিশ্চয়তাটুকুই তারা পাচ্ছেন না।
তারা বলেন, অতীত ‘অপকর্মগুলো’ বোঝা হয়ে উঠেছে কারও ওপর। কেউ আছেন নতুন রাজনৈতিক সরকারের আশায়।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ‘শহীদদের’ তালিকা নিয়ে গেল ১৬ জানুয়ারি প্রথম গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যেখানে সারাদেশের ৮৩৪ জন ‘শহীদের’ নাম স্থান পেয়েছে।
আর ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত ঘটনাবলী নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশন, সেখানে বিভিন্ন ‘নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া’ মৃত্যুর তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা দেওয়া হয়েছে যে এ সময়ে মধ্যে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, বেশিরভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী অস্ত্র, সামরিক রাইফেল এবং শটগানের গুলিতে নিহত হন।
আন্দোলন দমনে এমন অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনায় গত ৫ অগাস্ট পটপরির্বতনের পর পুলিশ সদস্যরা নিজেদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন।
আন্দোলনে অনেক পুলিশ সদস্য হতাহত হওয়া এবং পুলিশকে জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য বাহিনীরই ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তাকে দায়ী করছিলেন তারা।
অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। সে সময় পুলিশের নিম্নস্তরের সদস্যদের মধ্য থেকে সংস্কারের দাবি উঠেছিল জোরেসোরেই।
ক্ষমতার পালাবদলের পর পুলিশ কাজে ফিরেছে, বিভিন্ন স্তরে রদবদল হয়েছে, সংস্কারের উদ্যোগ চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ বাহিনী সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে, যারা ইতোমধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাহিনীর কর্মকাণ্ড পরিচালনায় একটি স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠনের দাবি জানালেও তাতে আশানুরূপ ‘সাড়া’ মেলেনি বলছেন তারা।
এ অবস্থায় গত এক সপ্তাহে অন্তত ১২ জন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
পুলিশের এ কর্মকর্তারা সবাই কাজের ক্ষেত্রে নতুন নতুন নানা বাধার কথা বলেছেন। নেতৃত্বে থাকা পুরনোদের ওপর ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।
পুলিশের এই কর্মকর্তারা বলেন, বাহিনীতে সংস্কার হবে এটা এখন কেউই ‘বিশ্বাস করে না’। এখন পুলিশের মূল ‘সংকট’ হচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে।
তারা বলেন, জুলাই আন্দোলনে ‘নৃশংস’ হওয়া এবং পরে হামলা-হত্যার শিকার হওয়া পুলিশকে এখনো রাস্তাঘাটে মানুষ ‘অপমান-অপদস্ত’ করছে। একা পেয়ে পুলিশ সদস্যদের ‘মারধরের’ ঘটনাও ঘটছে। আওয়ামী লীগ নেই, এখন ‘জুলাই যোদ্ধা’ কিংবা অন্য রাজনৈতিক পরিচয়ে পুলিশের ওপর খবরদারি চলছে। রয়েছে জুলাই মামলার চাপ।
এই কর্মকর্তারা বলেছেন, গত সরকারের আমলে জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তার করা অনেক ব্যক্তি জামিনে বেরিয়ে গেছেন, অনেকে আন্দোলনের সুযোগে বিভিন্ন জেল থেকে পালিয়েছেন। পলাতক এসব ব্যক্তিদের অনেকেরই বোমা তৈরি এবং ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণও রয়েছে। তার ওপর গত সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়া তালিকাভুক্ত অপরাধী, একাধিক হত্যা মামলার আসামিদের অনেকেই ছাড়া পেয়েছেন। তাদের অনেকেরই আছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। এসব মিলিয়ে পুলিশের ওপর চাপ আছে।
মনোবল হারানো পুলিশের পক্ষে এ সময় জঙ্গি কিংবা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া অনেকটা অসম্ভব বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
পুলিশে ‘আতঙ্ক ও ভয়’ আছে
চট্টগ্রাম মহানগরীতে কাজ করা এসপি পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, “এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পুলিশকে এখন একেবারে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন মামলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার বাহিনীর সকলকেই আতঙ্কিত করেছে। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট আছেন এমন ঘটনাগুলোতে থানার পুলিশকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে পাঠানো বা কোন পদক্ষেপ নেওয়ানো যাচ্ছেন না।
“সবার শঙ্কা যদি পরবর্তী সরকার এলে আবার কোন ঝামেলা হয়। আবার ছাত্ররা যুক্ত, এমন আন্দোলন বা সংঘাতেও পুলিশ কার্যকরভাবে কিছু করতে পারছে না। ভয় ওই একটাই, যদি ওপর মহলে নালিশ যায়। কারণ ছাত্ররা জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল, সরকারেও তাদের অংশীজনরা রয়েছে।”
রংপুর রেঞ্জ থেকে সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশে বদলি হয়ে আসা একজন এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশে যারা অপকর্ম করেছে, তারা এখন আতঙ্কে আছে।”
তার ভাষ্য, “পরপর তিনটা বিতর্কিত নির্বাচন করে দিয়ে পুলিশ ব্যাপক বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। মাঠের কর্মকর্তারা সাধারণ বিষয়েও ঊর্ধ্বতনদের কথা শুনতেন না। আবার নির্বাচনগুলোর আগে-পরে গ্রেপ্তার বাণিজ্যও হয়েছে প্রচুর। সেই সময় যে গায়েবি মামলা হয়েছিল সেগুলোতে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অনেকেই প্রচুর বাণিজ্যও করেছেন।
“অনেকের বিরুদ্ধে এসব রাজনৈতিক লোকজনকে থানায় ধরে এনে নির্যাতন করার অভিযোগও উঠেছিল। এই কর্মকর্তারা এখন নানা শঙ্কায় আছেন। তাদের দিয়ে কোন কাজ করানো যায় না। তারাই বেশি বলে বেড়াচ্ছেন যে পুলিশ ভেঙে পড়েছে।”
এই পুলিশ কর্মকর্তার সিআইডিতে কর্মরত ব্যাচমেট বলেছেন, এখন পুলিশের অপকর্মকারীদের দায় সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলেই কেবল বাহিনীটিকে বাঁচানো সম্ভব।
তিনি বলেন, “জুলাই ইস্যুতে তো পুরো পুলিশ বাহিনীকেই এখন চোর-ডাকাতের পর্যায়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী। এর চেইন অব কমান্ড ধরে ধরে কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে দায়ীদের চিহ্নিত করা যায়। মানুষ হত্যার কমান্ড কোত্থেকে এলো, কার মাধ্যমে সেটা কার কাছে গেল এটা বের করা খুব দুরুহ নয়। মাঠের পুলিশের তো কমান্ড নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।”
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশের কে কে গণহত্যায় জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে হবে, তাদের দায় চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে পুরো বাহিনীর ওপর এই দায় দিয়ে বাহিনীকে দুর্জন বানিয়ে রাখলে পুলিশ কোনোদিনই ঘুরে দাঁড়াবে না।
“এজন্য পুলিশে একটি পৃথক জুলাই কমিশন করা যেতে পারে যাদের কাজ হবে জুলাইয়ে পুলিশের দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা।”
তিনি বলেন, “আরেকটা বিষয় হচ্ছে আন্দোলনের সময় ৪৪ জন পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যার বিচার দাবি ও প্রক্রিয়া নিয়ে খুবই কৌশলী হতে হবে। তা না হলে আন্দোলনে যুক্ত বহু মানুষ নিজেদের ‘পুলিশ হত্যায়’ অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে বলে ভাবতে পারেন। জনমানস থেকে এরকম চিন্তা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত ১৫ বছর গ্রেপ্তারের নামে ‘গুম’, কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা, ‘হেফাজতে নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের’ যে অভিযোগগুলো এখন উঠছে সেগুলোর প্রত্যেকটার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে পৃথকভাবে তদন্ত করতে হবে বলে তুলে ধরেন সিআইডি কর্মকর্তা।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “শাপলা চত্বরে হেফাজতের সঙ্গে যা হয়েছে সেটার সঙ্গে মোদী বিরোধী আন্দোলনকে মেলানো যাবে না। প্রত্যেকটার প্রেক্ষাপট ও কমান্ড চেইন ভিন্ন।”
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘গুমসহ নানা বিতর্কিত’ কাজে যুক্ত ছিলেন এবং জুলাই আন্দোলনে হত্যায় যুক্ত ছিলেন এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের (এএসপি থেকে উপরের দিকের) চিহ্নিত করা হচ্ছে। এমন ১১৯ কর্মকর্তাকে এখন বিভিন্ন ইউনিটে সংযুক্ত রাখা হয়েছে। ৮২ জনকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়েছে। আর কাজে যোগ না দিয়ে পলাতক আছেন ৫৭ জন কর্মকর্তা। গুমসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৪ জন কর্মকর্তাকে। চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, এমন আরও ৩০ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার করা পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনও রয়েছেন। তিনিসহ কয়েকজন সাবেক পুলিশ সদস্যকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
সংস্কার নিয়ে ‘হতাশা’
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন আইজিপি। সেখানে সংস্কারের বিষয়ে তার কণ্ঠে কেবল হতাশাই ঝরেছে।
স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠনের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর যে প্রস্তাব দিয়েছিল সে বিষয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন কোন কাঠামো দেয়নি জানিয়ে আইজিপি বাহারুল আলম বলছেন, “এই জায়গাটা নিয়ে আমরা এখনো অপেক্ষা করে আছি। আমরা সরকারকে জানাচ্ছি।
“আর এই সরকারের আমলে না হলে আর কখনো হবে না সেটা অনেকে বলেন। সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাটা এখনি করছি।”
৫ অগাস্টের পর বারবার আলোচনায় এসেছে পুলিশের সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে। রাষ্ট্রের অন্য খাতের মত পুলিশ সংস্কারেও কমিশন গঠন করে সরকার। গত অক্টোবরে প্রথম ধাপে গঠিত কমিশন প্রতিবেদন দিয়েছে ১৫ জানুয়ারি।
অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা অনুযায়ীই, বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চাওয়ার সুপারিশ এসেছে কমিশনে কাছ থেকে।
পুলিশ সংস্কারের জন্য সুপারিশ তৈরি করতে সাধারণ মানুষের মত নিয়েছিল কমিশনটি।
সেই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার ওপর জোর দেন।
বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রয়েছে। সেটা ঠিক করতে না পারলে কোনোভাবেই পুলিশ সংস্কার সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের কারণে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে রাখার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সুপারিশে।
পুলিশ সংস্কারের আলোচনা এখন কোন পর্যায়ে আছে এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, “আমরা খুবই আশান্বিত ছিলাম যে পুলিশ সংস্কার কমিশন যেহেতু গঠিত হয়েছে পুলিশের জন্য জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ রাখবেন। আমরাও আমাদের কিছু প্রস্তাব তাদের দিয়েছিলাম।
“এর মধ্যে প্রথমটা হচ্ছে, একটা স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠন। সরাসরি নির্বাহী বিভাগের অধীনে না থেকে পুলিশকে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেওয়া, সেটা প্রশাসনের ক্ষেত্রে নয়।
“পুলিশ সংস্কার কমিশন বিষয়টি নিয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তারা এটাকে বিশদ করেননি, কোনো কাঠামোও দেননি।”
তিনি বলেন, “আমাদের একটা প্রধান পরামর্শ ছিল পুলিশের কাজের সেই স্বাতন্ত্রটা বজায় রাখার জন্য। এই জায়গাটা আমরা এখনো অপেক্ষা করে আছি। আশা করি এটা আমলে নেওয়া হবে।”
দায় নিরূপণ চলছে, তবে সময় লাগবে
জুলাই-অগাস্টে সরকার পতনের আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ উঠে। আন্দোলনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের কাছে পুলিশের তরফ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু কারা সরাসরি গুলি নির্দেশ দিয়েছিল, গুলি করেছিল তা এখনো পুরোপুরিভবে জানা যায়নি।
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন গণঅভ্যুত্থানের পর আট মাস পার হয়ে গেছে। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন দায় নির্ধারণের কাজ চলছে। আসলে কারা এই নির্দেশ দিয়েছিল?
জবাবে আইজিপি বলেন, “এটা আসলে এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না। কারণ প্রতিটা মামলাই আমরা তদন্ত করছি। এখানে ঘটনাগুলো উঠে আসছে। কেউ বলছে যে আমার সময় উনি বলেছিলেন, আবার আরেকজন আরেকজনের কথা বলছেন। মামলাতো ১৫০০, এর মধ্যে হত্যা মামলাই ৬০০।
“মামলা সব তদন্ত শেষ হলে হয়তো চূড়ান্তভাবে আমরা বলতে পারবো এতজন লোক নির্দেশ দিয়েছিলেন, এতজন লোক গুলি করেছিলেন, এতজন লোক এই কাজে যুক্ত ছিলেন। পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ না হলে আমরা আসলে বলতে পারছি না।”
আন্দোলনের সময় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বিদেশে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আপনারা কী করছেন, জানতে চাইলে বাহারুল আলম বলেন, “মামলা তদন্তের পর্যায়ে গিয়ে যখন প্রমাণ হাতে আসে তখন দেশে যারা আছেন তাদের আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করি।
“আর যারা বাইরে আছেন পলাতক তাদের বেলায় আমরা ইন্টারপোলকে অনুরোধ করতে পারি ফেরত দেওয়ার জন্য। ইন্টারপোল তাদের সমস্ত সভ্য দেশগুলোতে আমাদের এই আবেদনটা পাঠিয়ে দেয়, ওনাদের ভাষায় এটাকে রেড নোটিস বলে।”
পরিপূর্ণ ‘সক্ষমতা’ কবে?
আইজিপি বলেছেন, তাদের এখনকার চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে, একেবারে পরিপূর্ণ কর্মক্ষম পুলিশ যেন সেবা দিতে পারে। কিন্তু সেটা যেন আবার ৫ অগাস্ট পূর্ববর্তী পুলিশের মত না হয়। এই পুলিশ হবে জনবান্ধব। তাই এবারের পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ‘আমার পুলিশ, আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’।
পুলিশের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা না থাকায় মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে তুলে ধরে তিনি বলেন, “মানুষ নিজে আইন হাতে তুলে নিয়ে কাউকে বিচার করা শুরু করল বা শাস্তি দেওয়া শুরু করল… এটা আমাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এটা আপনার আমার সাবইকে আওয়াজটা তুলতে হবে। আমাদের (পুলিশের) ওপর আস্থাটা পরিপূর্ণভাবে ফিরে আসলে এটা হতো না। আমরা চেষ্টা করছি যাতে আমাদের ওর মানুষ আস্থা রাখতে পারে।”
পরিপূর্ণ সক্ষমতা অর্জনে আপনাদের কতটা সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, “৫ অগাস্টের আগের যে পুলিশ ছিল সেটা কী পুরোপুরি সক্ষম পুলিশ, কার্যকরী পুলিশ অথবা আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পুলিশ ছিল? অবশ্যই না। আমরা চাইব, আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাহিনীকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে। এটা একটা অবিরাম যাত্রা। তারপরও একটা পর্যায় তো আছে। যখন মানুষ বলবে পুলিশ দুর্ব্যবহার করে না, সেবা পাওয়া যায়।”
তিনি বলেন, “আমরা বড় একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছি। সেটা থেকে কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের দরকার ছিল আরও বেশি বিশেষজ্ঞর সহায়তা, মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠার জন্য পরামর্শ, যেন লোকগুলোকে আমরা সেই জায়গা থেকে বের করে আনতে পারি।”
তদ্বিরের ‘যন্ত্রণা’ নিয়েও আইজিপি অনুযোগ করেছেন, “আমি সবাইকে বলতে চাই, আমি অনেক সময় অন্যায় আবদারের মুখোমুখি হই। অমুককে ছেড়ে দেন, অমুককে বদলি করে দেন, অমুককে পদক দেন-এমন আবদারও আসে। আমি যেন বিধিবিধান মেনে চলতে পারি, সেজন্য দেশবাসীর কাছে বিনীত প্রার্থনা জানাই। আমার প্রতি অন্যায় আবদার যতটুকু পারেন যেন কম হয়।”
পুরনো খবর:
পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ চায় সংস্কার কমিশন
সংস্কার: পুলিশ জনবান্ধব হবে কোন তালিসমানে
পোশাক বদলাচ্ছে পুলিশের, কর্মবিরতি প্রত্যাহার
আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানোর মামলা: 'হত্যাকাণ্ডের ভিডিও' তদন্ত সংস্থার