Published : 30 Apr 2025, 02:31 PM
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ধার করে বলতে হয়, “পাঠাগার শুধু বইয়ের সংগ্রহশালা নয়, বরং তা মানবসভ্যতার শত শত বছরের ইতিহাসের হৃদয়-স্পন্দন।” অর্থাৎ পাঠাগার তাবৎ বিশ্বপরিমণ্ডলের আদ্যোপান্তের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের ধারক, বাহক, সংগ্রহ ও সংরক্ষণশালা। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম ভূমিকা পাঠাগারের নয়, বরং পাঠাগার বা সমৃদ্ধ লাইব্রেরির ওপরেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও জ্ঞান চর্চার মানদণ্ড বিচার করা হয়।
এক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, “এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয়, এবং স্কুল-কলেজের চাইতে কিছু বেশি।” তিনি পাঠাগারকে স্কুল-কলেজের ওপরে স্থান দিয়েছেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, পাঠাগারে মানুষ “স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়; প্রতি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”
সরকারি, বেসরকারি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক পাঠাগার গড়ে তোলার ইতিহাস নতুন নয়। বইপ্রেমী বা জ্ঞানপিপাসু মানুষদের সামাজিক উদ্যোগে পাঠাগার স্থাপন করার ইতিহাসও বেশ পুরনো। পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় আদি থেকে যেমন একদল নিরলস পরিশ্রমী মানুষ কাজ করে গেছেন, তেমনি অন্য আরেকদল মানুষ পাঠাগারের দরজায় তালা ঝোলাতেও সংঘবদ্ধ হয়েছেন। এসব সংঘবদ্ধ মানুষের সংখ্যা খুব বেশি, এমন নয়। আবার পাঠাগারবান্ধব মানুষের সংখ্যাও অনেক হবে, তাও ভাবা যায় না। তবে এ বিষয়ে সমাজের বৃহৎ অংশের দৃষ্টিভঙ্গি ‘ভালো’, কিন্তু তারা এর সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত নন।
নানা সংকটের মুখোমুখি হয়েও অদ্যাবধি আমাদের মতো জ্ঞানচর্চা বিমুখ দেশে কতিপয় স্বপ্নবাজ মানুষ পাঠাগার আন্দোলনকে ধরে রেখেছেন। তথ্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত এই সময়েও তারা পাঠাগার ও বইপড়া নিয়ে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এটাই বা কম কিসে! এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু আমরা তার মূল্যায়ন তো দূরের কথা, মৌখিক প্রশংসাইবা করছি কতটুকু?
সমাজে পাঠাগার গড়ে তোলা সহজ, কিন্তু পাঠাগারকে পাঠাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা খানিকটা কষ্টসাধ্য। বন্ধুর পথ জেনেই বইকে সঙ্গী করে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদদের মতো মহৎ মানুষেরা বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের কথা ভেবেছেন এবং ওই অনুযায়ী নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। মাওলানা খেরাজ আলী ও পলান সরকার পাঠাগারকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন মানুষের দুয়ারে, বই পৌঁছে দিয়েছেন ঘরে ঘরে। তাদেরই উত্তরাধিকার বহনকারী পাঠাগার সংগঠকরা নিভৃতে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে বইপাঠ ও বইপাঠের উন্মুক্ত পাঠস্থান গড়বার লড়াই জারি রেখেছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলেও দেশের কতিপয় বিদ্যোৎসাহী মানুষ পাঠাগার নিয়ে চিন্তার পাশাপাশি যথাযথ কাজটুকু করার চেষ্টা করছেন। এই প্রচেষ্টাকে যখন আমাদের সাধুবাদ জানানোর কথা, ওই সময়েই উল্টো আমাদের উদ্বেগ দিনকে দিন বাড়ছে। কেন জানি আমরা পাঠাগারগুলোর শুভার্থী না হয়ে, বিনাশকারী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছি। বিশেষত ধর্মাশ্রয়ী এবং রাজনৈতিক দূরভিসন্ধির কতিপয় মানুষ এর বিরুদ্ধে খড়গ হস্তে নেমেছে। পাঠাগার বিরোধিতা ইদানিং বেড়েছে।
জুলাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাঠাগারগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে বেশ আশঙ্কা দেখা দেয়। গেল বছরের ৫ অগাস্ট থেকে দেশের নানা প্রান্তরে বেশ কিছু পাঠাগার ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হওয়ায় উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন পাঠাগার কর্মীরা। কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। গণআন্দোলনে আওয়ামী সরকার পতনের পরপরই রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ‘বেলগাছি লাইব্রেরি ও পাঠক ক্লাব’ আক্রান্ত হয়। আক্রমণের শিকার হয় ১৮৮৫ সালে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের দান করা জমিতে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের টাউন হল গণপাঠাগার। ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ‘সত্যেন বোস পাঠাগার’।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার একমাত্র সরকারি নিবন্ধিত বেসরকারি গ্রন্থাগার ‘আলোর পথযাত্রী’ পাঠাগারেও হামলা করা হয়েছে। হামলা চালিয়ে ভাঙচুর-লুটপাট করা হয়েছে গাইবান্ধা শহরের শতবর্ষী পাবলিক লাইব্রেরিতেও। নীলফামারীর ভিলেজ কেয়ার লাইব্রেরি ও ফেনীর ভাটিয়াল পাঠাগারও হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা পায়নি। এসব পাঠাগারের কম্পিউটার, প্রিন্টার্স থেকে শুরু করে মূল্যবান বইসহ বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য পুস্তক ও দলিলাদি নষ্ট করেছে। একইসঙ্গে পুড়িয়ে দেয়াও হয়েছে। গত বছর অগাস্টেই সারাদেশে কয়েকশত পাঠাগার আক্রান্ত হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে ধারণা পাওয়া যায়। যা খুবই নিন্দনীয়। একটি জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য এসব ঘটনা প্রধান অন্তরায়।
দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী বিশেষ এই শ্রেণির লোকজনের ‘পাঠাগার ও বইয়ের’ প্রতি কেন এত ক্ষোভ, তা আমরা জানি না। কিন্তু অনুমান করতে পারি, তাদের সকল ভয় মানুষের চিন্তার বিকাশলাভ নিয়ে। তারা মূলত জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ইতিহাসকে ভয় পায়। এই ভয়ই ‘তাদের আধিপত্যবাদী সত্ত্বা’কে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্বাধীন জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে নিজেদের দাঁড় করিয়ে দেয়। তাদের যাবতীয় বিরোধ মানুষের মুক্তচিন্তায়। তারা চায় না, উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চায় প্রজন্ম ইতিহাস সচেতন হয়ে বেড়ে উঠুক কিংবা তাদের মানস চেতনায় বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধিত হোক। এই না চাওয়ার প্রধান কারণ, তাদের পশ্চাৎপদতা, মৌলবাদিতা ও রাজনৈতিক কূটচাল।
এ যাবৎ দেশের সিংহভাগ পাঠাগার আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের বই এবং তাকে নিয়ে প্রকাশিত বইপত্র রাখা। একইসঙ্গে ‘অপরাধ’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের সংগ্রহও। মোটাদাগে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে’র বইপত্র রাখাটাই ‘অপরাধ’ বলে গণ্য করা হয়েছে। আদতে আমরা এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম কিনা, তা নিয়েও এখন ভাববার সময় এসেছে। এনিয়ে বেশ ভালোভাবেই ভেবে দেখতে হবে আমাদের।
ভাবতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তসলিমা নাসরিনকে নিয়েও। কেননা তাদের বইপত্র নিয়েও বিপদে পড়া পাঠাগারের সংখ্যা মোটেই কম নয়। এই তো কিছুদিন আগে, পাঠাগারে ওই লেখকদের বই রাখায় ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার হয়েছে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার ‘অভয়ারণ্য পাঠাগার’।
অভিযোগ তোলা হয়েছে, ওই লেখকগণসহ বিভিন্ন লেখকের বইয়ে তৌহিদী জনতা ‘নারীদের অধিকার আর ইসলাম বিদ্বেষী’ লেখা পেয়েছে! তারা এসব বইকে নাস্তিক্যবাদী বই হিসেবেও দাবি করেছে! তাদের মতে পাঠাগারে নাস্তিকতার চর্চা করা হয়! এমন অভিযোগও খুব একটা নতুন নয়। জীবনে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য কোনো বইয়ের এক পৃষ্ঠা না পড়ুয়ারাও হরহামেশেই এমন বুলি আওড়ায়। পাঠাগার ধ্বংস করার এ-এক প্রধান হাতিয়ার।
আমাদের দেশে পাঠাগার ও বইকে নিষিদ্ধ কিংবা ধ্বংস করতে ‘ইসলাম বিরোধী’ তকমাটুকু জুড়ে দেওয়াটাই যথেষ্ট। বই আন্দোলনে সম্পৃক্ত মানুষকে সহজে ঘায়েল করতে ‘নাস্তিক’ ট্যাগ দেয়াটাও উপযুক্ত শব্দবন্ধ। নিজেকে দিয়েই উদাহরণ দেই। নাগরিক ব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে গ্রামে গিয়ে নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলাম পাঠাগারভিত্তিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘প্রজন্ম সমাজ-সংস্কৃতি কেন্দ্র’। শুরু থেকেই এখানে গ্রামের চটুল, ধূরন্ধর রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ঘেঁষতে পায়নি। সুযোগও ছিল না শিক্ষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বাইরের বিশেষ কোনো শ্রেণিকে প্রধান করে তোলার। ওই ক্ষোভটুকুকেই সঙ্গী করে এ বছর জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটিতে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। চেষ্টা চলেছিল পাঠাগার দখল করে পার্টি অফিস করার।
চার মাসের মাথায়, এপ্রিলে প্রজন্ম সমাজ-সংস্কৃতি কেন্দ্রের তালা খুলে দিতে বাধ্য হলেও ওই বিশেষ ব্যক্তিবর্গ নিজেদের হার মেনে নেয়নি। ‘নাস্তিক’ ও ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার বাতিঘরের আলোটুকু নিভিয়ে দিতে তৎপর তারা। সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আমাকে নিয়ে প্রচারিত প্রোপাগান্ডা সকলের জন্যই উৎকণ্ঠার। দেশে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি অধিকাংশ পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কর্মী।
এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। কিন্তু পরিবর্তনটা ঘটবে কীভাবে, যদি না জ্ঞানচর্চার মুক্ত দ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়? সচেতন মানুষ মাত্রই এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠবেন। এই জগতে বই ও জ্ঞানচর্চার উপহার সক্রেটিসের হেমলক পান করে আত্মহত্যার বাধ্যবাধকতার মতোই। সমাজকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা সমবেতভাবে হেমলক উৎপাদন করব নাকি সক্রেটিসের মতো চিন্তাশীল মানুষদের বুদ্ধির মুক্তিকে গ্রহণ করতে ফসলি জমিন প্রস্তুত করব। এই প্রস্ততি ‘পাঠাগার ও বই ভাবনা’য় আমাদের পক্ষপাত কোন দিকে হবে, তা নিয়েও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।