Published : 01 May 2025, 08:07 AM
মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস প্রতি বছর ১ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ১৮৮৬ সালের শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিক আন্দোলনের স্মৃতিকে ধারণ করে এ দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়। শ্রমিকরা তখন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন, যা পরবর্তীতে শ্রম অধিকার আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আজও এই দিবস শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তার দাবির প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়। মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া ন্যায্য সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে এবার মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’। শুনতে ভালো লাগলেও শ্রমিক মালিক এক হওয়ার বিষয়টি খুব সহজ নয়। একজন শোষক আরেকজন শোষিত। শোষিত মানুষের ন্যায্য মজুরি মালিক পক্ষ দিতে সম্মত থাকলে নতুন দেশ গড়ে আসলেই কঠিন কাজ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ইতিহাস কী বলে? শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুগ ধরে লড়াই করে একটি সমতার সমাজ গড়া এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ রক্ত দিয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে। বিশেষত বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রুশ বিপ্লবের পর এক নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থান ওই স্বপ্নকে বাস্তবতার খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সমাজতান্ত্রিক কাঠামো সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠার আগেই বিশ্বের বহু জায়গায় ওই প্রচেষ্টাগুলো ধসে পড়ে। পুঁজিবাদ আবারও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায় এবং সাম্রাজ্যবাদের নতুন নতুন রূপে পুনরাবির্ভাব ঘটে। এমনকি প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের যুগেও সমাজে শোষণ-নিপীড়ন অব্যাহত রয়ে গেছে। এই বাস্তবতা সামনে রেখে আমরা কি বলব— মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই কখনোই শেষ হবে না?
প্রশ্নটি আজ আরও বেশি করে আমাদের তাড়িত করে, কারণ আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি, যখন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং গ্লোবালাইজেশনের ফলে মানব সভ্যতা এক অদ্ভুত দ্বৈত অবস্থায় পৌঁছে গেছে। একদিকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন, অন্যদিকে সমাজের বহু মানুষ এখনো চরম বঞ্চনায় দিন কাটাচ্ছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষকে দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাস্তবে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য মানুষকে মানবিকভাবে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। শোষণের রূপ শুধু বদলেছে— আগে যা অস্ত্রের জোরে হতো, এখন তা তথ্য, বাণিজ্য ও মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্যের মাধ্যমে চলছে।
এই বাস্তবতা সামনে এনে দেয় আরও কিছু গভীর প্রশ্ন। যেমন, মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, শ্রেণিসচেতনতা ও সমানাধিকারের আকাঙ্ক্ষা কি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে? পুঁজিবাদ যেভাবে ব্যক্তি স্বার্থকে সমাজের স্বার্থের চেয়ে বড় করে তোলে, তাতে করে কি মানুষ কেবল ভোগসর্বস্ব ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে? এটাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ— যেখানে বৈষম্য থাকবে, থাকবে নিপীড়ন, কিন্তু তা সহনীয় বা মেনে নেওয়ার মতো করে উপস্থাপন করা হবে?
সত্যি বলতে, মানুষের শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা কোনো সাময়িক বা ক্ষণস্থায়ী বিষয় নয়। ইতিহাসে যত বিদ্রোহ, বিপ্লব, গণআন্দোলন দেখা গেছে, সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল এই মুক্তির আকুলতা। প্রাচীন দাসপ্রথার অবসান থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, কৃষক বিদ্রোহ, শ্রমিক আন্দোলন, নারী অধিকার আন্দোলন— সবকিছুর মূলেই রয়েছে শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা কখনো নিঃশেষ হয় না, বরং এক রূপ থেকে আরেক রূপে বিবর্তিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেন ব্যর্থ হলো? এটিকে শুধু বাইরের শত্রুর ষড়যন্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা— গণতন্ত্রের ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, ব্যক্তি স্বাধীনতার দমন এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের অভাব—ব্যর্থতার কারণ হয়েছে। সমাজতন্ত্র শুধু অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক দর্শন নয়, এটি একটি মানবিক দর্শনও বটে। এর সফল বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব যখন তা জনঅংশগ্রহণমূলক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই শাসকশ্রেণি একধরনের 'নতুন শোষক শ্রেণি'তে পরিণত হয়েছে। ফলে যে বিপ্লব মানুষের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটাই পরিণত হয়েছে নতুন এক নিপীড়নব্যবস্থায়।
তবে এই ব্যর্থতা সমাজতন্ত্রের স্বপ্নের নয়, বরং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার। ইতিহাসের বিচারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, যা আমাদের শিক্ষা দেয়— শোষণমুক্তির সংগ্রাম কেবল প্রতীকী বা রাজনৈতিক লড়াই নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং চেতনার লড়াইও।
নতুন প্রজন্মকে এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন এক নতুন সমাজ ভাবনার— যা পুরনো আদর্শকে বর্তমান বাস্তবতায় রূপান্তর করবে। বর্তমানে পুঁজিবাদ ডিজিটাল মাধ্যম ও সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে ‘ভোগের মায়াজালে’ বন্দি করেছে। মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করছে না, বরং তাদের চাহিদা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে করে সামাজিক শ্রেণির ব্যবধান আরও প্রকট হচ্ছে। এই ব্যবধান তখন কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবেও একধরনের বিভাজন তৈরি করে।
এই বিভাজন দূর করতে হলে নতুন প্রজন্মকে শুধুই অর্থনৈতিক সমতা নয়, বরং ন্যায়ের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে, কেন একজন মানুষের দিন চলে বিশ টাকায় আর আরেকজন খরচ করে বিশ হাজার? কেন একটি শিশুর পড়ার টেবিল আছে, আরেকটি শিশুর ভাগ্যে জোটে না সামান্য আলোও? কেন একজন মানুষ ক্লান্তিতে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অন্ন খোঁজে, আর অন্য কেউ শুধুই ভোগের আনন্দে সম্পদ অপচয় করে?
এই প্রশ্নের উত্তর না পেলে আমাদের সব উন্নয়ন হবে ‘ভুয়া বিজয়’— যেখানে কিছু মানুষ সাফল্যের গল্প বলবে, আর বাকিরা বঞ্চনার দোলাচলে দুলবে।
আশার কথা হলো, পৃথিবীর ইতিহাস দেখায়, শোষণ যত চাতুর্যপূর্ণ হোক না কেন, মানুষের মধ্যকার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কখনোই মরে না। দুনিয়াজুড়ে এখনো নানা প্রান্তে মানুষ লড়ছে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য। লড়ছে নারী অধিকার, পরিবেশ, শ্রমিক অধিকার, আদিবাসী অধিকার, জাতিগত সাম্য, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি নানা ইস্যুতে। এই লড়াইগুলো একেকটি নতুন সাম্যবাদী চেতনার রূপ। এগুলোর সঙ্গে যদি শ্রেণিসচেতনতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা-সংগ্রাম যুক্ত হয়, তাহলে একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে ওঠে যারা শোষণকে শুধু প্রতিরোধ করে না, বরং তার বিকল্পও গড়ে তোলে।
শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন অধরা নয়, যদি আমরা এটিকে কেবল একটি রাজনৈতিক প্রকল্পের পরিবর্তে একটি মানবিক অভিযাত্রা হিসেবে ভাবি। এই অভিযাত্রায় আমাদের দরকার যুক্তি, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, বিকল্প কাঠামো নির্মাণ এবং সর্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। অর্থাৎ এক ধরণের ‘সহানুভূতির অর্থনীতি’, যেখানে অন্যের দুঃখকে নিজের হিসেবে বিবেচনা করার মতো মন তৈরি হয়। এই মন তৈরির জন্য দরকার সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন ও শিক্ষার নতুন মিশেল।
আমরা যদি নতুন প্রজন্মকে শুধুই ক্যারিয়ারমুখী না করে ‘মানুষমুখী’ করে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে এই দীর্ঘ শোষণমুক্তির যাত্রায় হয়তো নতুন আশার আলো ফুটবে। এটি হবে এমন এক সমাজ, যেখানে ‘হাতের পাঁচ আঙুল সমান না হলেও’ প্রতিটি আঙুল থাকবে সম্মানিত, নিরাপদ ও সহমর্মিতায় আবৃত। শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। ইতিহাসের প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের শেখায়— যেখানে ভালোবাসা, সাম্য ও সচেতনতা আছে, সেখানে আশার আলো থাকে এবং ওই আলোই হতে পারে আমাদের আগামী দিনের দিশা।
মানুষ শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যুগে যুগে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে, স্বপ্ন দেখেছে। অনেক ক্ষেত্রেই ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই থেমে গেছে। কিন্তু থেমে গেলেই কি স্বপ্ন মরে যায়? আসলে প্রতিটি ব্যর্থতা একেকটি নতুন বিকল্প চিন্তার ভিত্তি গড়ে দেয়। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা দেখিয়েছে—ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে, উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, শোষণ থেকে মুক্তি মেলে না। পুঁজিবাদের অতিশক্তি দেখাচ্ছে—ব্যক্তিস্বাধীনতার পাশাপাশি ন্যায্য মর্যাদাও লুণ্ঠিত হচ্ছে।
তাই প্রয়োজন এক নতুন বিপ্লবের— যা কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগতভাবেও রূপান্তরমূলক হবে। এই বিপ্লব বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক নির্ভরতা ও প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। এটি আমাদের কাঠামো বদলাতে, চিন্তার দিগন্ত খুলতে এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার সাহস ফিরিয়ে আনতে পারে।
ওই বিপ্লব এখনো বাকি। তবে যদি আমরা সত্যিই চাই, তবে এই অপূর্ণ বিপ্লবের পথে হাঁটা এখনো সম্ভব।