Published : 01 May 2025, 01:42 PM
কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। দেশ দুটিই এখন যুদ্ধংদেহী অবস্থায়। গত দুই দশকের মধ্যে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ঘটা সবচেয়ে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পর্যায়ে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে পাল্টাপাল্টি বয়ান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য অনুযায়ী ভারতের জনগনের মনের অবস্থা– “কাশ্মীরে হামলার ছবি দেখে ভারতের মানুষের রক্ত ফুটছে।” এই বক্তব্যের পর এই বিষয়ে সত্যাসত্য অনুভব করার জন্য আমি জার্মানির কাসেল শহরে থাকা আধা ডজন ভারতীয়ের সঙ্গে কথা বলি। পরবাসী এই ভারতীয়দের মতে এই আক্রমণ ভবিষ্যতে ভারতের ‘ডেমোক্রেটিক সেক্যুলারিজমকে’ অনেকটা প্রভাবিত করবে। তারা বলছেন, এর আগের সন্ত্রাসী আক্রমণগুলোতে ক্ষতিগ্রস্তের ধর্ম ভেদ না থাকলেও এই আক্রমণ সেই পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। যা স্পষ্টত ভারতের গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতাকে শক্ত আঘাত করেছে। পাশাপাশি প্রবলভাবে সামরিক প্রভাবিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য পর্যালোচনা করলেও একই ধরনের পাল্টা উত্তেজনা দেখা যায়। পাকিস্তানের যেহেতু গণতন্ত্রের প্রবল সংকট রয়েছে, তাই বর্তমান রাজনীতিকদের বক্তব্য দিয়ে সেখানকার জনআকাঙ্ক্ষা বোঝা কঠিন।
এই পাল্টাপাল্টি ‘ডিক্লেটরি পসচার’ স্বল্প সময়ে সামরিক উত্তেজনায় রূপ নেয়। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ‘লাইন অব কন্ট্রোল’-এ দুই দেশের মধ্যে ছয় দফা গোলাগুলিও হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান এই সীমান্তে আজ অবধি সামরিক উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী গত ২৯ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভারতের স্শস্ত্রবাহিনীকে পূর্ণ সম্মতি ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। হামলার ‘ধরন’, ‘লক্ষ্য’ বা ‘সময়’ কী হবে সে বিষয়েও ভারতীয় স্শস্ত্রবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। আবার ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যম দাবি করে যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার ‘ক্রেডিবল’ সূত্র বলছে ভারতের এই সামরিক আক্রমণ আগামী ২৪ বা ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে হতে পারে। সেই দাবি অনুযায়ী ভারত আগামী এক দেড় দিনের মধ্যে পাকিস্তানে এই আক্রমণ চালাতে পারে। যদিও এই সম্পর্কে ভারতের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কোনো কিছু এখনও উল্লেখ করা হয়নি।
ভারত-পাকিস্তানের এই দামামার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শান্তি প্রক্রিয়ার একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু এই আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম স্টেকহোল্ডার তাই প্রশ্ন হলো এই উত্তেজনামূলক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী? ভারত-পাকিস্তানের এই যুদ্ধ পরিস্থিতি এই অঞ্চলে নতুন নয়। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সবসময় দক্ষ, বুদ্ধিমান ও দায়িত্বশীল স্টেকহোল্ডারের ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব বিবদমান পক্ষের ওপর ন্যস্ত করে সমস্যার সমাধান আরও গতিশীল রেখেছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের মূল অস্ত্র ছিল ‘বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষতা’। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির মূলমন্ত্র ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ ছিল এই নিরপেক্ষতার চালিকা শক্তি। ফলে, আঞ্চলিক এই দ্বন্দ্বের মধ্যেও আঞ্চলিক পর্যায়ে অবাধ বিচারণে বাংলাদেশের কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। কারণ এই নিরপেক্ষতা সবপক্ষের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভাষায় সেই নিপেক্ষতার বিরুদ্ধ একটা আভা তৈরি হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানের কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে হঠাৎ ঘনিষ্ঠতা সেই পরিস্থিতিতে আরও কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে কোন দেশ কোন দেশের সঙ্গে কী ধরণের সম্পর্ক তৈরি করবে সেই অধিকার প্রতিটি দেশের রয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পরিপেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রে সেই চর্চায় কৌশলী হতে হয়। আর আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অস্থিতিশীলতা তৈরির আশঙ্কা তৈরি হলে পা ফেলতে হয় আরও কৌশলে। কারণ এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিবদমান পক্ষের অন্যতম লক্ষ্য থাকে দল ভারি করা। নানা ফাঁদ ও লোভনীয় প্রস্তাবের মাধ্যমে বিবদমান পক্ষ তাদের পক্ষের দল ভারী করতে সচেষ্ট হয়। দলে ভিড়তে বাধ্য করে। ভারত-ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই ধরনের কোনো প্রচেষ্টা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই এই দ্বন্দ্বের সময় বাংলাদেশের মূল মন্ত্র হতে পারে নিরপেক্ষতা। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের উচিত হবে কূটনৈতিক পর্যায়ে নিরপেক্ষ তৎপরতা রাখা। সজাগ থাকা যেন কোনোভাবেই কোনো পক্ষের কাছেই ভুল বার্তা না যায়। যেহেতু বাংলাদেশ এখন এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা ও অস্থিতিশীল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেখানে এই সাবধানতা অতি জরুরি। অন্যথায় দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। যা দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে আঞ্চলিক বৈরিতা। এই ধরনের রাজনৈতিক পরিমার্জন ও অস্থিতিশীল সময়ে বৈদেশিক শক্তিগুলো এক ধরনের ধাঁধার মধ্যে থাকে। সেক্ষেত্রে কে বন্ধু আর কে শত্রু সেটি বোঝা অনেক কঠিন। তাই এই মুহুর্তে কাউকে বন্ধু বা শত্রুজ্ঞান করে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো আত্মঘাতী হবে।
ব্যারি বুজান ও ওলে বেফারের ‘রিজিওনাল সিকিউরিটি কমপ্লেক্স থিওরি’ অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান হলো দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির প্রধান ‘অ্যাক্টর’। দুই দেশের স্থায়ী দ্বন্দ্ব ও সামরিক প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার ‘সিকিউরিটি কমপ্লেক্স’কে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে চায়নার ক্রমবর্ধনশীল অংশগ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান স্বার্থসিদ্ধি এই নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে। যা ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পেক্ষাপটকে পরিবর্তন করে ফেলছে। যার ফলে এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো সামরিক সংকট তৈরি হলে সেটির ভবিষ্যৎ অনুমান করা অনেক কঠিন। এই অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা তাদের এই আঞ্চলিক শক্তির কেন্দ্রে বসতে সাহায্য করেছে। দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা প্রায় কাছাকাছি। তাই, বর্তমানে এই দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সবশেষ কোথায় গিয়ে থামবে সেটা বলাও কঠিন হবে। কারণ গত কয়েক দশকে দুই দেশের ঘরের রাজনীতির অনুঘটকগুলো বহুলাংশে বদলে গেছে। একদিকে ভারত যেমন ডেমোক্রেটিক সেক্যুলারিজম থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। একইভাবে গণতন্ত্রহীন পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপ অতীতের যে কোনো ঘটনার চেয়ে আরও ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
তবে, দুই দেশের মধ্যে যেহেতু একধরনের প্যাসিভ নিউক্লিয়ার ডিটারেন্স রয়েছে সেহেতু যুদ্ধ যে বেশি দীর্ঘ হবে না সেটি অন্তত আন্দাজ করা যায়। কারণ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো তাদের ‘ভেস্টেড ইন্টেরেস্ট’-এর কারণে দুটি পারমাণবিক শক্তির মধ্যে দীর্ঘ যুদ্ধের আশঙ্কা জিইয়ে রাখতে চাইবে না। তবুও স্বপ্ল মেয়াদী বা মাঝারি হোক ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কোনো কারণে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় অতি সাবধানতার বিকল্প নেই। কূটনৈতিক তৎপরতা যুদ্ধের নয়, শান্তির পক্ষে হতে হবে।
কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ উল্টো দিকে যাচ্ছে। অন্তত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কথায় তাই মনে হয়েছে। ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আয়োজিত ‘আকাশ বিজয়’ মহড়া শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি রীতিমতন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথাই বলে দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য, ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির মধ্যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি না নেওয়াটা ‘আত্মঘাতী’ এবং প্রস্তুতি নিতে হলে ‘আধাআধি প্রস্তুতি’র কোনো জায়গা নেই।
অবশ্য একই বক্তব্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস নিজেকে একজন যুদ্ধবিরোধী মানুষ বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, “অনেকের মতো আমিও যুদ্ধবিরোধী মানুষ। পৃথিবীতে যুদ্ধ হোক, এটা কামনা করি না। যুদ্ধ প্রস্তুতি অনেক সময় যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। কাজেই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েও একটা ঘোরতর আপত্তি। কিন্তু এমন বিশ্বে আমরা বাস করি, প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি আমাদের ঘিরে থাকে। সেখানে প্রস্তুতি না নিয়ে থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
প্রধান উপদেষ্টা ৩০ এপ্রিল দেওয়া ওই বক্তব্যে বলেছিলেন, “আমাদেরই কাছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থার মধ্যে রয়েছে। সকালের খবরে দেখলাম, হয়তো গুজব, আজকেই শুরু হয়ে যাবে যুদ্ধ।”
যুদ্ধ এখনও শুরু হয়নি এবং যুদ্ধটা গুজবে শেষ হলেই ভালো হয়। যদি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে, বাংলাদেশের উচিত হবে ওই যুদ্ধের অংশভাগী না হওয়া।