Published : 30 Apr 2025, 07:50 AM
গোয়েন্দাকাহিনি সাহিত্যের খুব পাঠকপ্রিয় একটি জনরা। একটু রহস্য, সেসব রহস্যের সমাধান, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের একজন গোয়েন্দা—যার রয়েছে চমৎকার পর্যবেক্ষণ শক্তি ও রহস্য সমাধানের বিভিন্ন সব কৌশল, এ সব কিছুই পাঠককে আলাদা একটা জগতে নিয়ে যায়। একটা ছুটির দিনে কিংবা ব্যস্ত দিনের একটু অবসরে ধোয়া ওঠা এক কাপ চা কিংবা কফির সাথে একটা রোমাঞ্চকর গোয়েন্দাকাহিনি খুব ভালো মানিয়ে যায়।
বিশ্বসাহিত্যের শার্লক হোমসকে আমরা সবাই চিনি। তার বন্ধু ডাক্তার ওয়াটসনও আমাদের পরিচিত। এছাড়া রয়েছে মিস্ট্রি কুইন খ্যাত আগাথা ক্রিস্টির অসাধারণ দুই গোয়েন্দা চরিত্র: এরকুল পোয়ারো ও মিস মার্পেল। পাঠকদের মাঝে এসব গোয়েন্দারা এতটাই বেশি পরিচিত যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই চরিত্রদের বইয়ের পাতায় যারা এঁকেছেন তাদের কথাও পাঠক ভুলে যায়। স্রষ্টাকে ছাপিয়ে যায় তার সৃষ্টি।
বিশ্বসাহিত্য থেকে যদি এখন বাংলাসাহিত্যের দিকে আসি তাহলে দেখা যায় আমাদের নিজেদেরও কিন্তু গোয়েন্দা চরিত্রের কমতি নেই। বাংলাসাহিত্যেও সৃষ্টি হয়েছে চমৎকার কিছু গোয়েন্দাকাহিনি এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কিছু গোয়েন্দা যারা তাদের রহস্য সমাধানের কৌশল কিংবা সত্যান্বেষণের প্রতি তাদের প্রবল নিষ্ঠা দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করেছে।
বাংলাসাহিত্যের গোয়েন্দাদের কথা বলতে গেলে সবার শুরুতেই বলতে হয় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় চরিত্র টেনিদা। এর পরই মনে পড়বে স্বনামধন্য ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর কথা যিনি নিজেকে গোয়েন্দার বদলে সত্যান্বেষী বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ব্যোমকেশ বক্সী বাংলা সাহিত্যে প্রবল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিখ্যাত শার্লক হোমসের সাথে কিন্তু আমাদের ব্যোমকেশ বক্সীর মিল রয়েছে: দুজনেরই রয়েছে অসাধারণ শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও পর্যবেক্ষণ শক্তি। শার্লকের সাথে বন্ধু বা সহযোগী হিসেবে যেমন রয়েছে ডাক্তার ওয়াটসন, তেমনিভাবে ব্যোমকেশের সাথে রয়েছে তার বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি একজন লেখক। অজিতের কলমেই ব্যোমকেশের সত্যান্বেষণের কাহিনিগুলো উঠে আসতো যেমনটা হত শার্লকের ক্ষেত্রে ডাক্তার ওয়াটসনের কলমে। শার্লকের ক্ষেত্রে প্রেম-বিয়ের বিষয় না থাকলেও, ব্যোমকেশের ক্ষেত্রে প্রেমটা এসেছে এবং সে সংসারীও হয়েছে। তার স্ত্রীর নাম সত্যবতী—এক রহস্যের সত্যান্বেষণ করতে গিয়েই এ দুজনের পরিচয়। সে রহস্য কাহিনিটির নাম অর্থমনর্থম্। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য কয়েকটি ব্যোমকেশ কাহিনি হল: সত্যান্বেষী, পথের কাঁটা,সীমন্ত-হীরা, চোরাবালি, উপসংহার, রক্তমুখী নীলা, চিত্রচোর, দুর্গরহস্য, চিড়িয়াখানা, অচিন পাখি, কহেন কবি কালিদাস, মগ্নমৈনাক, ছলনার ছন্দ,শজারুর কাঁটা, বেণীসংহার।
বেশ কিছু ব্যোমকেশ কাহিনি নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ‘চিড়িয়াখানা’ যার পরিচালনায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়। অভিনয়ে ছিল উত্তম কুমার(ব্যোমকেশ) ও শৈলেন মুখোপাধ্যায় (অজিত)।
আমরা যারা বাংলাসাহিত্য পড়ি, বাংলা সিনেমা দেখি তারা একটা নামের সাথে ভীষণভাবে পরিচিত। নামটি হল সত্যজিৎ রায়। সেইসাথে আরোও একটি নামের সাথে আমরা পরিচিত আর সেই নামটি হল ফেলুদা কিংবা প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। ফেলুদাকে বাংলা সাহিত্যের এক তুখড় জনপ্রিয় গোয়েন্দা হিসেবে মানা হয়। বয়স তার প্রায় সাতাশ, লম্বায় সে ছ ফুট এবং সিগারেট হিসেবে তার পছন্দ চারমিনার। তার নিবাস বালিগঞ্জ, কলকাতা। যোগব্যায়াম, সিনেমা, ও গানে তার আগ্রহ। এবং সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বিভিন্ন রহস্যে। ফেলুদারও একজন সঙ্গী রয়েছে। নাম তার তোপসে। তার কাকার ছেলে। পাঠক ছাড়া এই তোপসেই ফেলুদার সবচেয়ে বড় ভক্ত। ফেলুদার ও রয়েছে শার্লক ও ব্যোমকেশের মত একজন বন্ধু—নাম লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু, পেশায় তিনি রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক। এই দুজনের জুটি কিন্তু দারুণ। একজন রহস্য সমাধান করেন এবং আরেকজন অদ্ভুত সব রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি রচনা করেন যার প্রতিটিই খুব বিক্রি হয়। ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ দিয়েই সত্যজিৎ রায় ফেলুদা কাহিনির শুরু করেন এবং পরবর্তীতে অসাধারণ সব কাহিনি রচনা করেন। ফেলুদাও তার বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ শক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে রহস্যের কিনারা করে। উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি ফেলুদা কাহিনি হল: ‘বাদশাহী আংটি’, ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘রয়াল বেঙ্গল রহস্য’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘গোলকধাম রহস্য’, ‘নেপোলিয়নের চিঠি’, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’, ‘লন্ডনে ফেলুদা’, ‘রবার্টসনের রুবি’ ইত্যাদি। নিজের ফেলুদা কাহিনি নিয়ে সত্যজিৎ রায় সিনেমাও বানান—সোনার কেল্লা ও জয়বাবা ফেলুনাথ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’ চরিত্রটি বাংলাসাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি চরিত্র। কাকাবাবু ও সন্তু—এ জুটির সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত। কাকাবাবুর নাম রাজা রায়চৌধুরী, সন্তু তার ভাইয়ের ছেলে। কাকাবাবু মধ্যবয়সী এবং অসামান্য মনের জোর তার। তিনি ভারত সরকারের প্রত্বতত্ত্ব বিভাগের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তার একটি পা নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু এতে তার মনের জোর, সাহস এবং অজানাকে জানা বা রহস্যের কিনারা করার যে অদম্য স্পৃহা, তাতে কোনো কমতি হয়না। ক্রাচে ভর করেই তিনি হাটেন, পাহাড়ে ওঠেন, দুর্গম সব রাস্তা পাড়ি দেন এবং এসব এডভেঞ্চারে তার সঙ্গী হিসেবে থাকে ভাইপো সন্তু এবং মাঝেমধ্যে সন্তুর সাথে তার বন্ধু জোজোও। কাকাবাবুর গল্পগুলো শুধু গোয়েন্দা গল্প নয়, পাঠক হিসেবে এটাকে আমি এক ধরণের ভ্রমণও বলব। কারণ সন্তুকে নিয়ে রহস্য সমাধানে কাকাবাবু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় যান এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্ণনায় সেখানে উঠে আসে অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা। অদম্য সাহসী এই মানুষটি পাঠককে অনুপ্রাণিত করে। মনের জোর কত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা থাকলে কত কিছুই না করে ফেলা যায়।–এমনই এক বার্তা থাকে এই চরিত্রের মধ্যে। উল্লেখযোগ্য কিছু কাকাকাবু কাহিনি হল: ‘ভয়ংকর সুন্দর’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘পাহাড় চুড়ায় আতঙ্ক’, ‘মিশর রহস্য’, ‘বিজয়নগরের হীরে’ প্রভৃতি।
গোয়েন্দা কাহিনি যারা নিয়মিত পড়েন বা এক সময়ে পড়তেন তারা সবাই কিশোর পাশা, মুসা আমান, ও রবিন মিলফোর্ডের সাথে পরিচিত। রকিব হাসানের সৃষ্টি তিন গোয়েন্দা—কিশোর গোয়েন্দা। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সিরিজ হল তিন গোয়েন্দা সিরিজ। তিন কিশোর বন্ধু মিলে বিভিন্ন রহস্য সমাধান করে। অনবদ্য সেসব কাহিনি। বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে ১৯৮৫ সাল থেকে মূলত রকিব হাসানই এই সিরিজটি লেখা শুরু করেন। সম্পূর্ণ মৌলিক না হলেও, তিন গোয়েন্দা কাহিনি কিশোরদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমনকি বড়রাও এক ধরনের নস্টালজিয়া থেকে এখনও তিন গোয়ন্দার গল্পগুলো পড়েন। তিন গোয়েন্দা সিরিজের বইগুলোর শুরুতে একটা পরিচিতি থাকে। পরিচিতিটা হল:
‘’হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা—
আমি কিশোর পাশা বলছি অ্যামিরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি। নাম
তিন গোয়েন্দা।
আমি বাঙালি, থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান। ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো; অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা।
একই ক্লাসে পড়ি আমরা।
পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরান এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার।
তিনটি রহস্যের সমাধান করতে চলেছি—
এসো না, চলে এসো আমাদের দলে।‘’
সেবা প্রকাশনী থেকেই আসে পরবর্তী গোয়েন্দা চরিত্রের নাম। বাংলা কথাসাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টি এক জনপ্রিয় চরিত্র হল মাসুদ রানা। এই সিরিজের প্রতিটি বই সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সিরিজটিতে চারশরও অধিক বই রয়েছে। সিরিজের প্রথম দুটি বই ‘ধ্বংস-পাহাড়’ ও ‘ভারতনাট্যম’মৌলিক রচনা হলেও প্রায় বাকি বইসমূহ বিভিন্ন বিদেশি বইয়ের অবলম্বনে রচিত।
এছাড়াও রয়েছে সমরেশ মজুমদারের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন, যার নিবাস ভারতের জলপাইগুড়িতে। প্রাক্তন গোয়েন্দা অমল সোম তার গুরু। অর্জুনও ব্যোমকেশের মত নিজেকে গোয়েন্দা বলতে পছন্দ করে না। সে নিজেকে সত্যসন্ধানী বলে পরিচয় দেয়। অর্জুন সমগ্রের প্রথম বইটির নাম ‘খুনখারাপি’ যা ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কিছু বই হল: ‘দেড়দিন’, ‘অর্জুন এবার বাংলাদেশে’, ‘কালাপাহাড়’, ‘ম্যাকসাহেবের নাতনি’ ইত্যাদি।
বিশ্বসাহিত্যে যেমন আছে আগাথা ক্রিস্টির সৃষ্ট নারী গোয়েন্দা চরিত্র মিস মার্পেল তেমনি বাংলা সাহিত্যে আছে সূচিত্রা ভট্টাচার্যের সৃষ্ট নারী গোয়েন্দা মিতিন মাসি। কলকাতার ঢাকুরিয়ায় তার নিবাস। মিতিনের ভালো নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জী। বোনজি টুপুরের কাছে সে মিতিন মাসি এবং পাঠকদের কাছেও ঠিক তাই।
বাংলাসাহিত্যের আরোও অনেক গোয়েন্দা চরিত্র রয়েছে। এক লেখায় সবার কথা তুলে আনা সম্ভবপর হলো না। তবে যারা গোয়ন্দা কাহিনি পড়েন তারা অবশ্যই উপরে উল্লেখিত সব চরিত্রদের চেনেন, জানেন এবং ভালোবাসেন। কেউ কেউ আবার তাদের মত হতে চান। যেমন আমি নিজে পাঠক হিসেবে যখন কাকাবাবু ওরফে মি. রাজা রায়চৌধুরীর কথা পড়ি, আমি তার থেকে খুব অনুপ্রেরণা পাই—থেমে না যাওয়ার, সামনে এগিয়ে যাওয়ার, মনে সাহস রাখার। সেই সাথে অনুপ্রেরণা পাই প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হবার, ভ্রমন করার এবং বিভিন্ন বিষয়ে জানাশোনার। আবার যখন রিডিং ব্লকে পরে যাই বা অন্য কোনো বই পড়তে পারিনা তখন ফেলুদা কাহিনি ও ব্যোমকেশ কাহিনির কাছে ফিরি। সেগুলো পড়ি এবং আবার নিজেকে পাঠক হিসেবে ফিরে পাই। গল্পের কাহিনি যদি হয় টান টান উত্তেজনার এবং রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর এবং সেখানে যদি থাকে চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক গোয়েন্দা কিংবা সত্যের অনুসন্ধানকারী তখন এক কাপ চা আর এরকম এক বই হাতে এক প্রহর কেটে যায় এক নিমিষেই।