Published : 30 Apr 2025, 10:04 PM
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হান কাঙের মোট আটটি উপন্যাসের মধ্যে এটি পঞ্চম, তবে ইংরেজিতে প্রকাশের হিশেবে চতুর্থ। ২০১১ সালে কোরীয় ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পরে ২০২৩ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রথমবার হান কাঙের একাকী ইংরেজি অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ তরুণ এক কোরীয় অনুবাদক এমিলি ইয়ে ওয়ানের সাথে যুগলবন্দি রচনা করেছেন, যা, আশা করা যায়, তাঁর অনুবাদের মর্মগ্রাহিতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, অনুবাদে মূল পাঠের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা যেন আরও নিপুণ অক্ষরে ফুটে ওঠে তা নিশ্চিত করেছে, এবং অনুবাদকের স্বভাবসুলভ বিচ্যুতিপ্রবণতা থেকে অনূদিত পাঠটিকে আরও সজাগ ও-সুযোগ্যভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। বাংলা অনুবাদটি যেহেতু এই ইংরেজি অনুবাদের মারফত মূল কোরীয় উপন্যাসটির রূপ-রস- ও গন্ধ বাংলাভাষী পাঠকের সংবেদনশক্তির নিকট নিবেদন করছে তাই এ-তথ্যটুকু উৎসাহব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। আজ প্রকাশিত হলো উপন্যাসটির পঞ্চম কিস্তি।
****
আমি চল্লিশ ছুঁইছুঁই করছি, তোমার বাবার হুঁশিয়ারি মতো যেটা হওয়ার কথা শেষ সীমা, কিন্তু এখনো আমি আংশিক দৃষ্টিশক্তি টিকিয়ে রেখেছি। সম্ভবত এক কি দুই বছরের মধ্যেই আমি পুরোদস্তুর অন্ধ হয়ে পড়বো। এক দীর্ঘ, ধীর প্রক্রিয়া ছিলো এটি, আর এতোদিনে আমার আর কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার বাকি নেই। একজন কয়েদি যেমন তার জন্যে মঞ্জুর করা একটিমাত্র সিগ্রেটে লম্বা করে শেষ টানটি দেয়, তেমনি করে রোদেলা দিনগুলোয় আমার বাড়ির সামনের গলিতে বসে দীর্ঘ দীর্ঘ বিকেল আমি পার করে দেই প্রাণ ভরে দৃশ্য পান করে।
সউলের শহরতলির একটি গঞ্জ-জেলার এই গলি দিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ যাতায়াত করে। কানে ইয়ারফোন দিয়ে রাখা এক কিশোরী, তার স্কুলের স্কার্ট যেমন-তেমনভাবে উঠিয়ে রাখা। জীর্ণ ট্র্যাক্স্যুট আর ভুঁড়িওয়ালা এক মধ্যবয়সি লোক। মোবাইলে কথা বলতে থাকা এক মহিলা, যার তাক-লাগানো পোশাক দেখে মনে হয় যেন তিনি একটা ফ্যাশন পত্রিকার পাতা থেকে সবে বেরিয়ে এসেছেন। ঝিকমিকে কারুকাজের সোয়েটার পরা, ছোটো করে ছাঁটা শাদা চুলের বয়স্ক এক মহিলা, যিনি আয়েশ করে আগুন ধরাচ্ছেন সিগ্রেটে। কোথায় কে যেন উগ্রভাবে খিস্তি করছে, আর একটা রেস্তোরাঁ থেকে ভেসে আসছে গুকবাপের সুবাস। সাইকেলে চড়া এক ছোকরা যতো জোরে পারে ঘণ্টি বাজিয়ে সাঁই করে আমার পাশ দিয়ে চলে যায়।
সর্বোচ্চ যে-পাওয়ারের চশমা জোগাড় করতে পেরেছি তা দিয়েও এসবের কোনোটিরই খুঁটিনাটি ঠাহর করতে পারি না। আলাদা আলাদা আকৃতি ও অঙ্গভঙ্গি মিলেমিশে ঝাপসা হয়ে পড়ে, আর স্পষ্টতা যতোটুকু বিরাজ করে তা আমার কল্পনার জোরে। বিদ্যালয়-পড়ুয়া মেয়েটি নিশ্চয়ই যে-গানটি শুনছে তা-ই মুখ নাড়িয়ে আওড়াচ্ছে, আর তার নিচের ঠোঁটের বাঁ-দিকে নিশ্চয়ই রয়েছে ছোট্ট নীলচে একটি দাগ, ঠিক যেমন তোমারটিতে ছিলো। মধ্যবয়সি লোকটির ট্র্যাক্স্যুটের আস্তিন নিশ্চয়ই ময়লা আর পর্তে পর্তে মলিন করে ফেলা, আর তার ট্রেইনারের ফিতেগুলো, আসলে যেগুলো ছিলো শাদা, সেগুলো নিশ্চয়ই মাসের পর মাস আধোয়া থাকার ফলে হয়ে পড়েছে কালচে ধূসর। সাইকেলে চড়া ছেলেটির মাথার দু’পাশ থেকে নিশ্চয়ই টপটপিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। বুড়ো মহিলাটিকে দেখতে লাগছে জবরদস্ত এক বান্দা; তাঁর সিগ্রেট নিশ্চয়ই সরু, সুচারু কোনো ব্র্যান্ডেরই হবে, আর তাঁর সোয়েটারের ওপরে শোভা বর্ধন করতে থাকা ‘মুক্তোমাতৃকা’র কতোগুলো নিরেট ঝিকিমিকি টুকরো নিশ্চয়ই গোলাপ বা রতনরাজি ফুলের আকার ধারণ করে থাকবে।
মানুষ-দেখা আর এর আনুষঙ্গিক কল্পনাবিলাস যখন একঘেয়ে হয়ে ওঠে, আমি তখন পাহাড়ের দিকে চলে যাওয়া পথ ধরে হাঁটতে থাকি ওপরের দিকে। ফিকে সবুজ বৃক্ষরাজি অবিচ্ছিন্ন শরীরে ঢেউ খেলিয়ে এগিয়ে চলে, তাদের ফুলগুলো অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর সব রঙের মিছিল। পাহাড়ের পাদদেশের ছোট্ট মন্দিরটিতে এসে পৌঁছোলে আমি সমাবেশ-কক্ষের বাইরে থাকা কাঠের পাটাতনে বসে জিরিয়ে নেই। নিজের ভারী চশমা খুলে আমি পৃথিবীর আবছা হয়ে পড়া অবয়বরেখার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকি। লোকের বিশ্বাস হলো অন্ধ বা আংশিক চক্ষুষ্মান মানুষেরা সবার আগে, অন্য কিছুর চাইতে বেশি ঠাহর পাবে নানা শব্দের, কিন্তু আমার বেলায় ব্যাপারটা তা নয়। সর্বপ্রথম যেটা আমি অনুভব করি তা হচ্ছে সময়। আমি টের পাই, এটি আমার শরীরের মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলা বিপুলাকৃতি ধীর, নিষ্ঠুর স্রোত রূপে পর্যায়ক্রমে আমায় পরাভূত করছে।
আলো ক্ষয়ে এলে আমার দৃষ্টিশক্তি যেহেতু দ্রুতই খারাপ হয়ে আসে, তাই খুব বেশিক্ষণ এখানে আমার বসে থাকা হয় না। আমি বাড়ি গিয়ে কাপড়চোপড় বদলে নেই, মুখে পানি দেই। আমার ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়াতে যেতে হয় আমাকে, বলি তাহলে – পাঠদান শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটায়, যেটা তোমাদের দুপুরবেলা, যে-সময়টায় তুমি সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সবচে’ বেশি ভালোবাসতে। আলো থাকতেই আমি সাধারণত বেসরকারি আকাদেমিতে পৌঁছে যাই, তারপর সাতটা বাজার অপেক্ষা করি। আলোকোজ্জ্বল ভবনটির ভেতরে আমি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই চলাফেরা করি, তবে চশমা চোখে দিয়েও রাতের বেলায় রাস্তা ধরে একা হেঁটে চলা হচ্ছে এক দুর্ভোগ। দশটার দিকে, পাঠদান যখন সমাপ্ত হয় এবং ছাত্রছাত্রীরা সারি বেঁধে বেরিয়ে যায়, আমি তখন আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে আকাদেমির প্রবেশমুখে একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে আনি।
আমি আকাদেমিতে কী পড়াই?
সোম ও বৃহস্পতিবারে আমি প্রাথমিক প্রাচীন গ্রিক পড়াই, আর শুক্রবারে থাকে মূল ভাষায় প্লেটো পড়ার মাধ্যমিক পাঠদান। প্রতিটি শ্রেণিতে আট জনের বেশি ছাত্র নেই। পাশ্চাত্ত্য দর্শনে আগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আর বিভিন্ন বয়স ও পরিমণ্ডলের অন্যান্য জনের মিশ্রণ তারা।
যারা গ্রিক নিয়ে পড়াশোনা করে, তাদের অনুপ্রেরণা যা-ই হোক, কিছু প্রবণতাগত মিল তাদের রয়েছে। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাঁটাচলায় ও কথাবার্তায় ধীরস্থির, এবং বেশি ভাবাবেগ প্রকাশ করে না (ধারণা করি, এ-কথা আমার বেলায়ও প্রযোজ্য)। সম্ভবত এ-জন্যে যে, এই ভাষা দীর্ঘকাল ধরেই মৃত এক ভাষা আর এতে মৌখিক যোগাযোগের অবকাশ নেই। নীরবতা, অপ্রতিভ সংকোচ আর নিঃশব্দ হাসির প্রতিক্রিয়া শ্রেণিকক্ষের ভেতরকার হাওয়া ধীরে তাতিয়ে তোলে, এবং ধীরে জুড়িয়ে ফেলে।
আর এমন করেই দিন কেটে যায় এখানে, ঘটনাবিহীন।
ক্বচিৎ ঘটে যাওয়া স্মরণীয় ঘটনাও সময়ের বিপুল, অনচ্ছ বপুর তলায় একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
যে-বছর আমি প্রথম কোরিয়া ছেড়ে জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিলাম, আমার বয়স সে-বছর পনেরো। যতোদিনে আমি ফিরতি যাত্রা করেছিলাম ততোদিনে আমার বয়স যেহেতু হয়েছিলো বত্রিশ, কাজেই সেই মুহূর্তে আমার জীবন প্রায় সমান দুই খণ্ডে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো, বিভক্ত হয়েছিলো দু’টি ভাষায়, দু’টি সংস্কৃতিতে। আমার বয়স চল্লিশ হলে তোমার বাবার হুঁশিয়ারি মতো কালপরিক্রমায় যা যা বদল দেখা দেওয়ার কথা সেসব সহকারে বসবাস করার জন্যে এই দুই খণ্ডের যে-কোনো একটিকে বাসস্থান হিশেবে বেছে নিতে হয়েছিলো আমাকে। আমি যখন বলেছিলাম, যে-দেশে আমি আমার মাতৃভাষায় কথা বলতে পারবো সেখানেই আমি ফিরে যেতে চাই, আমার পরিবারপরিজন, শিক্ষকমণ্ডলীসহ চারপাশের সকলেই তখন আমাকে বুঝিয়েশুনিয়ে মত বদলাতে চেষ্টা করেছিলো। আমার মা ও ছোট বোন দু’জনেই আমায় জিগেস করেছিলো যে, মাতৃভূমিতে ফিরে গিয়ে কী করার পরিকল্পনা করেছি আমি। তারা বলেছিলো, প্রাচীন গ্রিক দর্শনে আমার যে এতো কষ্টার্জিত ডিগ্রি তা ওখানে মূল্যহীন, আর আমার পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে, পরিবারের মানুষদেরকে যে আমার দরকার পড়বে সে তো বলারই অপেক্ষা রাখে না –একাএকা আমি সামলাতে পারবো না। বিরাট ঝক্কির পরেই কেবল পরীক্ষামূলকভাবে দু’বছর আমার একাএকা থাকার পরিকল্পনায় তাদেরকে রাজি করাতে পেরেছিলাম।
প্রাথমিক সেই দুই বছরের তিনগুণ সময় ধরে এখানে আছি আমি, তারপরেও একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। যে-মাতৃভাষার অভাব অসহনীয়ভাবে বোধ করেছিলাম তাতে চমৎকৃত হয়ে, অভিভূত হয়ে কাটিয়ে দেওয়া সেই প্রথম শরতের পরে, চতুর্দিক থেকে ভূমিধ্বসের মতো ধাঁই ধাঁই করে ধেয়ে এসেছিলো শীতকাল, এবং সউল আমার কাছে বরং অচেনা-ই লাগতে শুরু হয়েছিলো, যেমন করে একটা সময় লেগেছিলো জার্মান শহরগুলো। উলের বিবর্ণ কোট ও জাম্পারের ভেতরে কুঁজো হয়ে থাকা মানুষজন হিমজমাট রাস্তা দিয়ে তড়বড়িয়ে পা চালানোর সময় আমার গা ঘেঁষে চলে যেতো। তাদের চেহারা বলতো দীর্ঘ ভোগান্তি সইবার কথা, এমনকি দীর্ঘতর যে-ভোগান্তি এখনও দেখা দেয়নি তার কথাও। আমি জার্মানিতে যেমনটি করেছিলাম এখানেও তেমন করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম, নির্বিকার এক পর্যবেক্ষক।
তো এইভাবেই আছি আমি এখানে, ভাবালুতা ও আশাবাদের কাছে নতিস্বীকার করা থেকে কোনোরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে। অস্বাভাবিক রকমের লাজুক ছাত্রছাত্রী, মানববিদ্যা আকাদেমির খুঁতখুঁতে অধ্যক্ষ, যিনি হাতেগোনা ক’জন ‘তারকা’ প্রভাষককে নিয়োগ দিয়ে কোনোক্রমে মুনাফা তোলেন এবং কার্যক্রম চালু রাখেন, আর বব-ছাঁটের চুলওয়ালি খণ্ডকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, হে-ফিভারের কারণে, যে-মৌসুমই হোক, যাঁর পক্ষে সার্বক্ষণিক টিশু ছাড়া টেকা সম্ভব হয় না – এদের সাথে খুচরো আলাপসালাপ এখানে দিন কাটানোর সময় আমাকে খানিকটা নির্মল আনন্দ দিয়ে থাকে। যে-বাক্যগুলো সেদিন পাঠদানকালে আমরা পড়বো সকালবেলায় আতশ কাচ দিয়ে সেগুলো দেখে দেখে মুখস্ত করে নেই; হাতমুখ ধোয়ার বেসিনের ওপরকার আয়নায় ভেসে ওঠা আমার মুখের ঘোলাটে প্রতিবিম্ব নিয়ে ভাবনায় তন্ময় হয়ে থাকি, আর যখন মনমর্জি হয় আলোকোজ্জ্বল রাস্তায়-রাস্তায় আর অলিতেগলিতে আস্তেসুস্থে হেঁটে বেড়াই। কখনো কখনো এমন সময়ে আমার চোখে জ্বালাপোড়া হয় আর চোখ দু’টো জলে ছলছল করতে থাকে। নিতান্তই শারীরবৃত্তীয় এসব অশ্রু যখন কোনো কারণে থামার নাম করে না, আমি চুপচাপ পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মুহূর্তটুকু কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকি।
*****
যে-পথ দিয়ে এসেছিলে, ঘুরে সেদিকে প্রাম ঠেলে দেওয়ার সময় তোমার তামাটে চেহারায় কি ভরা রোদ্দুর থাকে? তোমার হাতে তোলা এক গুচ্ছ ঝাঁকড়া কাউন ঘাস কি তোমার দু’বছরের কন্যার মুঠো-করা হাতে দোলে? নদীর ধার থেকে সোজাসুজি বাড়ি যাওয়ার পথ না-ধরে তুমি কি ওই প্রাচীন মহাগির্জার সামনে গিয়ে থামো? তুমি কি তোমার দুই সবল বাহু দিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে প্রামটাকে গির্জার রক্ষণাবেক্ষকের কাছে রেখে গিয়ে মহাগির্জার ভেতরকার শীতলতায় পা রাখো?
এমন একটি স্থান যেখানে নকশাদার রঙিন কাচের জানালা ভেদ করে নীলের হরেক রকমফেরে একনাগাড়ে প্রবাহিত হয় বরফভেজা সূর্যের আলো। এমন একটি স্থান যেখানে যন্ত্রণার সামান্যতম চিহ্ন ছাড়াই ক্রুশে ঝুলে থাকেন খ্রিস্ট, অকপটচিত্তে তাঁর দুই চোখ তোলা স্বর্গের পানে, আর ফেরেশতারা মৃদু কদমে বাতাসে বিচরণ করেন, যেন আপনমনে পায়চারিতে বেরিয়েছেন। নিজেদেরকে কমনীয়ভাবে মেলে ধরা কী ঘন সবুজ পাতার কতোগুলি তালগাছ। ফ্যাকাশে নীল-ধূসর চুলধারী আর ততোধিক ফ্যাকাশে নীল-ধূসর যাজকীয় আলখাল্লায় আচ্ছাদিত জ্যোতির্ময় চেহারার সন্তগণ। পাপ বা যন্ত্রণার আভাসবিহীন একটি স্থান, আর সে-কারণেই যেটিকে আমার প্রায় পৌত্তলিক বোধ হয়েছিলো: সন্ত স্টেফানের গির্জা।
অতোগুলো বছর আগে, শেষ-গ্রীষ্মের সেই সন্ধ্যায় আমরা যখন সেখানে পাশাপাশি হাঁটছিলাম, তুমি তোমার নোটবইয়ে কিছু-একটা লিখে আমাকে দেখিয়েছিলে। বলেছিলে যে, তুমি গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়েই বড় হয়েছো, তবে যতো চেষ্টাই করেছো, তাতে স্বর্গ-নরকের মতো কট্টর কিছুতে বিশ্বাস আনতে পারো নি। বরং, তোমার কাছে মনে হতো যে, আত্মারা বাস্তব এবং ঊষালগ্ন অব্দি আঁধার-জমে-থাকা পথে পথে তারা ঘোরাফেরা করে। আর এহেন আত্মার যদি অস্তিত্ব থাকে, তাহলে কোথাও না কোথাও ঈশ্বরেরও নিশ্চয়ই অস্তিত্ব আছে। আমার কাছে এটা কৌতুকজনক মনে হয়েছিলো যে, খ্রিস্টীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসের যে-দাবি তুমি করেছিলে তার ভিত্তি যে শুধু অযৌক্তিকই ছিলো তা নয়, বরং ছিলো সম্পূর্ণ অখ্রিস্টীয়ও এবং অট্টহাসি হাসতে হাসতে আমি হাতে নিয়েছিলাম তোমার নোটবই। আমি ঈশ্বরের অনস্তিত্বের যে-একটি মীমাংসা কোথাও পড়েছিলাম তা লিখে দিয়ে নোটবইটি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
এই জগতে অশুভ রয়েছে, আর সেটি নির্দোষ মানুষদেরকে দুর্দশাগ্রস্ত করে।
ঈশ্বর যদি শুভ হন কিন্তু এ-দুর্দশা নিরসনে অক্ষম হন, তাহলে তিনি ক্ষমতাহীন।
ঈশ্বর যদি শুভ না হন, বরং নিছক সর্বক্ষমতাধর হন, আর এসব দুর্দশা নিরসন না করেন, তাহলে তিনি অশুভ।
ঈশ্বর যদি শুভও না হন সর্বক্ষমতাধরও না হন, তাহলে তাকে ঈশ্বর বলা যায় না।
অতএব, একজন শুভ ও সর্বক্ষমতাধর ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্ব হচ্ছে একটি অসম্ভব ভ্রান্ত ধারণা।
তুমি সত্যিসত্যি রেগে গেলে তোমার চোখ দু’টো বিস্ফারিত হয়। তোমার ঘন ভুরু ওপরে উঠে যায়, তোমার চোখের পাপড়ি ও ঠোঁট স্ফুরিত হয়, এবং হাঁপাতে হাঁপাতে সামলানো প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথেসাথে তোমার বুক ওঠানামা করে। কলমটা আমি ফিরিয়ে দিতেই তুমি নোটবইয়ে খসখস করে লিখেছিলে: সেক্ষেত্রে আমার ঈশ্বর একইসঙ্গে শুভ ও দুঃখভারাক্রান্ত। তুমি যদি এইসব নির্বোধ যুক্তিতর্কের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকো, তাহলে একদিন তোমার নিজের বাস্তব অস্তিত্বই একটি অসম্ভব ভ্রান্ত ধারণায় পর্যবসিত হবে।