তবে এই নৃশংস শতাব্দির শেষের দিকে এসে একজন লেখকের পক্ষে জীবন সম্পর্কে বিয়োগান্ত দৃষ্টিভঙ্গি না রেখে কুলিয়ে ওঠা কঠিন, আর মারিও বার্গাস ইয়োসা লিখেছেন সুবিশাল মাপের একটি আধুনিক বিয়োগান্ত রচনা, অবশ্য দয়া করে সাড়ম্বর ঢঙে লেখেননি।
Published : 18 Apr 2025, 11:22 PM
পেরুর সবচাইতে গুরুত্ববহ জীবিত ঔপন্যাসিক, মারিও বার্গাস ইয়োসা অনেক বছর ধরেই তাঁর দেশের রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করেছেন। এই ক্ষেত্রে দক্ষিণের বহু লেখকের সাথেই তাঁর মিল রয়েছে আর তাঁর উদীচ্য সহকর্মীদের সাথে রয়েছে অমিল। উদাহরণ হিশেবে বলা যেতে পারে, তিনিই হয়তো একমাত্র ঔপন্যাসিক যাঁকে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেওয়ার পরেও যিনি কিনা তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন—তাছাড়াও এমন লেখকের সংখ্যা নিশ্চয় অল্পস্বল্পই হবে—এবং তিনি হয়ে রয়েছেন পেরুর রাষ্ট্রপতি বেলাউন্দে তেরির একজন প্রভাবশালী সমর্থক। বেলাউন্দেকে পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্যে বার্গাস ইয়োসা কতকটা সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন, যথা সেসব বামপন্থী গোষ্ঠী ও লেখকের তরফ থেকে যাঁরা পাহাড়ের সেন্দেরো লুমিনোসো(Shining Path) গেরিলাবাহিনী সম্পর্কে তাঁর পর্যালোচনা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তিনি এরকম পালটা তর্ক করেছেন যে, সারা পৃথিবী যখন বোধ হয় প্রায় এমনটাই প্রত্যাশা করে যে, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস আগাগোড়াই গড়া হবে কতোগুলো সহিংস বিপ্লব আর দমনপীড়নমূলক একনায়কতন্ত্র দিয়ে, তখন তাঁর নিজের ঝোঁকটি রয়েছে মানবীয় বিষয়াশয় নিয়ন্ত্রণের অপেক্ষাকৃত কম চটকদার একটি পদ্ধতির প্রতি—অর্থাৎ, পুরনো, ত্রুটিপূর্ণ, ভাঙাচোরা গণতন্ত্রের ধারণার স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত কোনো রকমফের, সম্ভবত এখনো পর্যন্ত এমন একমাত্র ভাবনা যার সাহায্যে ভাঙা যেতে পারে অভ্যুত্থান ও পালটা অভ্যুত্থানের প্রাণসংহারী চক্র। অস্বীকারের জো নেই, এটি বিশ্বাস-জাগানিয়া একটি দৃষ্টিকোণ।
হেলেন আর. লেইনের সুচারু, সাবলীল অনুবাদে ইংরেজিতে হাজির হওয়া তাঁর সরবে অভিনন্দিত উপন্যাস মহাপ্রলয়ের যুদ্ধ-এ বার্গাস ইয়োসা করাল এবং হিংস্র স্পষ্টতায় লিপিবদ্ধ করেন যে-কোনো প্রকার সহস্রাব্দবাদী জনতার বিয়োগান্ত পরিণাম বিষয়ক তাঁর রূপকল্পটিকে। তিনি ইতঃপূর্বে ক্যাপ্টেন পান্তোহা আর বিশেষ সেবা উপন্যাসে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এমন এক তপস্বী চরিত্রের আবির্ভাব নিয়ে লিখেছেন যে কিনা একটি সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে; তবে সেটি ছিলো মূলত হাস্যরসাত্মক একটি উপন্যাস, আর নতুন বইটি হচ্ছে ছিটকে পড়া রক্তের মতো কালচে। আর যদিও এটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাসের সাজে সজ্জিত হয়ে আছে—যার ভিত্তি, আমাদেরকে বলা হচ্ছে, ব্রাজিলীয় ইতিহাসের ‘বাস্তব’ একটি কালপর্ব—পাঠ্যবস্তু হিশেবে এর মূল্য পুরোপুরি সমসাময়িক। রক্তপিপাসু সব সৈন্যবাহিনী আর সমানরকম সহিংস দেব-দেবতায় আক্রান্ত আমাদের যে-যুগ তাতে, ঈশ্বর আর ধনপিশাচ কুবেরের প্রাণপণ এক লড়াইয়ের বৃত্তান্ত সমসাময়িক ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না, যদিও বার্গাস ইয়োসা তাঁর যুদ্ধটিকে স্থাপন করেছেন প্রত্যন্ততম এক স্থানে---দুনিয়ার ‘শেষপ্রান্তে’, তথা উনবিংশ শতাব্দির ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব ভাগে। তাঁর কল্পনাপ্রসূত মসিহ, পথপ্রদর্শক, কেবল একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে বললে, শিখ নেতা, সন্ত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের পূর্বাবির্ভাব হয়ে দাঁড়ায়, যে কিনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা যায় অমৃতসরের বিখ্যাত স্বর্ণমন্দিরে, যে-মন্দিরটি নিজেই বার্গাস ইয়োসার কাল্পনিক, খ্রিস্টীয় ‘কানুদোস’-এর একটি জলজ্যান্ত বাস্তব সংস্করণ।
পথপ্রদর্শক আন্তোনিও কুনসেলেইরু হচ্ছেন একজন শীর্ণকায়, সম্ভ্রম-সঞ্চারী পুণ্যাত্মা যিনি উনবিংশ শতাব্দির শেষ দশক বা তার কাছাকাছি সময়ে বাহিয়া প্রদেশের পাণ্ডববর্জিত এলাকায় এলাকায় পদব্রজে ঘুরে বেড়ান, পরিষ্কার ও সহজবোধ্য ভাষায় চাষা-ভুষা-মজদুরদেরকে তাদের আধ্যাত্মিক দায়দায়িত্ব বিষয়ে উপদেশ দেন, তাদেরকে উৎসাহিত করেন সে-অঞ্চলের বহু ভগ্নদশাপ্রাপ্ত, পাদ্রিবিহীন গির্জা মেরামতের কাজে তাঁকে সহায়তা করতে, ধীরে ধীরে নিজের চারপাশে জড়ো করে তোলেন একদল ভক্ত বা শিষ্যদের একটি একান্ত মণ্ডলী, নতুন সহস্রাব্দের সঙ্গে যে-ভয়াবহ মহাপ্রলয় উপস্থিত হবে বাগবিভূতি সহকারে সে-সম্পর্কে তাদেরকে হুঁশিয়ার করেন:
“১৯০০ সালে আলোর সকল উৎস নির্বাপিত হবে এবং তারকাগুলো বৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে। কিন্তু, তার আগে, অসামান্য সব জিনিশ ঘটবে... ১৮৯৬ সালে... সাগর পরিণত হবে পাণ্ডববর্জিত গ্রামাঞ্চলে আর পাণ্ডববর্জিত সব গ্রামাঞ্চল পরিণত হবে সাগরে... ১৮৯৮ সালে মাথার যতো হ্যাট সেসব আকারে বেড়ে উঠবে আর মাথাগুলো হয়ে পড়বে আগের চাইতে ছোটো, এবং ১৮৯৯ সালে নদীগুলো লালে লাল হয়ে যাবে আর নতুন এক গ্রহ মহাশূন্যে চক্কর কাটবে। কাজেই, প্রস্তুত হয়ে থাকাটা ছিলো জরুরি।”
এসব আলামতের কোনোটা প্রকাশ পাওয়ার আগেই, অবশ্য, চলে আসে এমন লগ্ন যার পরে পেছনে ফিরে যাবার আর উপায় থাকে না। স্বৈরাচারী সামন্ত জমিদার আর বহির্জগৎ সম্পর্কে নিরেট মূর্খতার দ্বিমুষ্টি কবলে রয়ে যাওয়া সেই ‘বাহিয়া’, খুব বেশি দিন হয়নি যেখানে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, শুনতে শুরু করে অলক্ষুণে উন্নয়নের কথা। একটি প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা হয়েছে, এবং সেটি জনশুমারি আর, এর চাইতেও যা খারাপ, করারোপ করতে চায়। পাণ্ডববর্জিত গ্রামাঞ্চলের মানুষদের জন্যে এসব হচ্ছে রীতিমতো সহ্যের সীমা লঙ্ঘন। দাসপ্রথাকে ফের চাপিয়ে দেওয়ার মতলব না থাকলে প্রজাতন্ত্র কী জন্যে চাইছে যে, সকলের ওপরে শুমারি আর বিবরণী হোক? আর, তাছাড়া, “সহজাত পশুপ্রবৃত্তি, কাণ্ডজ্ঞান এবং কয়েক শতকের অভিজ্ঞতার ফলে মফস্সলীরা তৎক্ষণাৎ টের পেলো... যে, নয়া গোমস্তারা শকুন আর ডাকাতের চাইতেও বেশি লোভী হবে।” পথপ্রদর্শক তাঁর বাণীতে ফুটিয়ে তোলেন তাদের ভয়ংকরতম যতো ভীতি। তিনি এরশাদ করেন যে, “দজ্জালকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে দুনিয়ায়; তার নাম প্রজাতন্ত্র।” তারপর তিনি তাঁর অনুসারী হতে ইচ্ছুক লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে গমন করেন সবচে বড়ো সামন্ত জমিদার এবং ‘বাহীয় স্বায়ত্তশাসনবাদী দল’-এর প্রধান ব্যারন দে কানাব্রাভার ভূসম্পত্তির অংশ কানুদোসের সুরক্ষিত আশ্রয়ে। পরিস্থিতির পরিহাসবশত, ওই দলটি নতুন প্রজাতন্ত্রের প্রতি হুবহু একই মাত্রায় বৈরী, যদিও সম্পূর্ণত স্বার্থান্বেষণের অপবিত্র কারণে।
কানুদোসে পথপ্রদর্শক আরম্ভ করেন ‘বেলো মন্তে’র নির্মাণ ও সুরক্ষিতকরণের কাজ, যা কিনা একটি শহর আর একটি গির্জা, নতুন এক জেরুসালেম যার ওপরে দজ্জাল তার দলবল, লোক-লশকরকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পাঠাবে। চারটি অগ্নিকাণ্ড হবে, পথপ্রদর্শক তাঁর মেষপালকে বলেন (যে-পাল ফুলে-ফেঁপে ৩০,০০০-এরও বেশি লোকে গিয়ে ঠেকে), আর এর মধ্যে তিনটিকে তিনি প্রশমিত করবেন, তবে চতুর্থটিকে তিনি তাদেরকে গ্রাস করবার অনুমতি দেবেন। কাজেই কানুদোসের যুদ্ধের চারটি লড়াইয়ের কথা আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপরে যা আসে তাতে থাকে একটি গ্রিক বিয়োগান্ত নাটকের ধীর, থমথমে অবশ্যম্ভাবিতা—যদিও সে-নাটক অভিনীত হয় জঙ্গলে—সমাপ্তি সম্পর্কে আমাদের যে-অবগতি তা কেবল আমাদের যন্ত্রণা বাড়ানোরই কাজ করে।
বার্গাস ইয়োসার রচনাকৌশল যেন তাঁর অসাধারণ লেখকতাজীবন জুড়ে এই বইটি লিখবারই প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলো; তাঁর গদ্য হয়ে উঠছিলো সহজসরল, আঙ্গিক-প্রকরণ হচ্ছিলো স্পষ্টতর। তাঁর প্রথমদিকের বেশ চমকপ্রদ ক’টি উপন্যাস নায়কের সময় আর সবুজ বাড়ি-র কাঠামোগত নানা জটিলতা এবং কখনো-কখনো ইচ্ছাকৃত বলে মনে হওয়া দুর্বোধ্যতা থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন পান্তোহা এবং জুলিয়া আন্টি আর সেই চিত্রনাট্যকার -এর হাস্যরসাত্মক সুখপাঠ্যতা, এমনকি বিদঘুটে রঙ্গরসিকতা হয়ে বর্তমান উপন্যাসের আরও নিরেট, কারুনির্মিত, ঐতিহ্যগত সদগুণাবলি পর্যন্ত—এ এক দীর্ঘ যাত্রা। এর মধ্য দিয়ে জনতুষ্টিবাদের দিকে একপ্রকার অধোগতির পরিচয় পাওয়া যায় এরকমটা মনে করা কিন্তু কিছুতেই সমীচীন হবে না; বরঞ্চ এমনটাই মনে হওয়ার কথা যে, বার্গাস ইয়োসা পর্যায়ক্রমে একজাতীয় জটিলতা থেকে আরেক জাতীয় জটিলতার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। কিংবা, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, প্রকরণগত জটিলতা থেকে ভাবনার জটিলতার দিকে। মহাপ্রলয়ের যুদ্ধ-এর নৈবেদ্যে বিলক্ষণ পাওয়া যাবে দীর্ঘ, খুঁটিনাটি-সাবধানী ঐতিহাসিক উপন্যাসে যেসব প্রথাগত পরিতৃপ্তি থাকে তার অনেক ক’টিই—হারানো এক জগতের পুনর্নির্মিতি; আয়েশি, পরিমিত চালের বৃত্তান্ত; একরকম হাত-পা ছড়িয়ে চলতে পারার বোধ; এবং নিপুণ হাতের যত্নে থাকার অনুভূতি—তবে এ-উপন্যাসে হদিশ মেলে বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্কে সরগরম কাল্পনিক এক মহাবিশ্বেরও, যে-মহাবিশ্বের অধিবাসীরা রাজনৈতিক আর আধ্যাত্মিক দু’ধরণের বিষয়াশয় নিয়েই সবিস্তারে ও তুমুল তেজে তুলকালাম করতে যেমন উৎসাহী তেমনি পারদর্শী।
অবশ্য আমার বিশ্বাস, এই প্রকৃষ্ট উপন্যাসের মহত্তম গুণাবলি নির্দোষ মানুষজনের যে-হত্যাযজ্ঞ দিয়ে উপন্যাসের কাহিনিতুঙ্গ ঘটে সেদিকে এর অবশ্যম্ভাবী গ্রিক অগ্রগতিও নয়, আবার এর বুদ্ধিবৃত্তিক পুঙ্খানুপুঙ্খতাও নয়। সেই গুণাবলি হচ্ছে যে-কাহিনিটি খুব সহজেই হয়ে পড়তে পারতো আড়ম্বরমণ্ডিত সেখানেও মানবীয়তার মাত্রাটি কখনোই পরিহার না করার প্রবণতা; তার ওপর, এক দ্ব্যর্থদ্যোতকতার বোধ যার সুবাদে বার্গাস ইয়োসা তাঁর চরিত্রগুলোকে কেবলই ভালো, বা মন্দ, বা অন্য কোনও বিমূর্ত প্রত্যয়ের প্রতিনিধি করে নয়, বরং ত্রিমাত্রিক করে রাখতে পারেন; আর সবশেষে ভাগ্যের এমন পরিহাস সম্পর্কে প্রগাঢ় সচেতনতা যে, ওই প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই হাজারো সাধারণ নর-নারী মারা পড়ে যে-প্রজাতন্ত্র নীতিগতভাবে প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিলো তাদেরকে সেবাদানের উদ্দেশ্যে এবং তাদের প্রাক্তন সামন্তপ্রভুদের ধনলিপ্সা থেকে তাদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে।
কাহিনির বেশিরভাগটাই দেখা হয় কিষাণী জুরেমা-কেন্দ্রিক একদল চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে। সে ব্যারন দে কানাব্রাভার সামন্তদাস, অনুসরণপটু শিকারি রুফিনোর স্ত্রী, আর সে যখন অর্বাচীন বিপ্লবী গালিলিও গলের দ্বারা ধর্ষিত হয় এবং তার সাথে এক সার্কাস দলের খপ্পরে পড়ে, তখন আত্মসম্মানের রীতিমাফিক রুফিনোর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় গালিলিওর পিছু নিয়ে তাকে হত্যা করা। দুই পুরুষ যখন সত্যিসত্যি একে অপরের হাতে খুন হয়ে যায়, জুরেমা তখন কানুদোসে এসে পৌঁছে, তার সঙ্গে থাকে রূপকথার কথক এক বামন, যে কিনা সার্কাসদলের একমাত্র টিকে থাকা সদস্য; এছাড়াও সঙ্গে থাকে ‘হ্রস্বদৃষ্টি সাংবাদিক’ বলে পরিচিত এক চরিত্র, উপন্যাসের আবেগীয় মর্মস্থলে রয়েছে যার শিশুসুলভ সারল্য থেকে ক্ষতবিক্ষত পরিপক্বতায় উত্তরণ। অতএব, মৌখিক ও লিখিত দুই সাহিত্যেরই প্রতিভূ জুরেমার সঙ্গী হয়, এবং এদের কেউই কানুদোসের সাথে খাপ খাওয়াতে সমর্থ হয় না। বামনের কেচ্ছা শোনার জন্যে কেউই তেমন অর্থকড়ি দিতে চায় না; ওদিকে সেই সাংবাদিকের চশমা ভেঙে যায় আর সে বিরাট বিরাট ঘটনাকে দেখে ছায়াবাজির মতো, কিংবা শেষমেশ একরাশ খোলামকুচির মতো, কেননা সে পরকলা দু’টির টুকরোটাকরা জোড়া দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলো একচোখের চশমা। জনৈক দৃষ্টিবঞ্চিত প্রত্যক্ষদর্শী হচ্ছে দুঃখজনক এক চিত্রকল্প, আর সাংবাদিক লোকটি এক মর্মস্পর্শী চরিত্রই বটে। এ-শব্দশিল্পীদেরকে জুরেমা-ই বাঁচিয়ে রাখে, খানিকটা এ-কারণে যে, কানুদোসের এক সর্দার, সাবেক-ডাকু পাজেউ তার প্রেমে পড়ে। আখ্যানে মেয়েটির অবস্থানকে কিছুটা কৃত্রিমভাবেই কেন্দ্রীয় করে তোলা হয়, এ-কথা সত্যি; উপন্যাসের শেষের দিকে, ব্যারন দে কানাব্রাভা সাংবাদিকটির কাছ থেকে কানুদোসের পতনের কাহিনি শুনতে গিয়ে এ-কথা জেনে বিস্মিত হন যে, লোকটি রুফিনোর স্ত্রীকে বিয়ে করেছে (গণহত্যার মধ্যে বেঁচে যাওয়া মুষ্টিমেয় ক’জনের ভেতরে রয়েছে ওরা দু’জন):
“এতোসব দৈবঘটনা, কাকতালীয় ঘটনা, আকস্মিক সাক্ষাৎ... [ব্যারনের] হঠাৎ এমন উদ্ভট অনুভূতি হলো যে, কালুম্বির সাবেক চাকরানিই যেন সার্তাউ ভূমির একমাত্র নারী, এমন এক রমণী যার অমোঘ জাদুমন্ত্রে কানুদোসের সাথে সামান্যতম সম্বন্ধ থাকা সকল পুরুষই এক সময় না এক সময় বশীভূত হয়েছে।”
ব্যাপারটি কিছুটা এরকমই; তবে জুরেমা এহেন অসম্ভাব্য ও গতানুগতিক কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কারণেই সম্ভবত কারসাজিটি বড়ো একটা বিচ্ছিরি লাগে না। এবং কতোগুলো ব্যক্তিজীবনের ওপরে যে আমাদের নজর নিবদ্ধ রাখতে হচ্ছে সে কথা ভাবলে উপন্যাসের বিস্তর ফায়দাই হয়েছে বলতে হবে।
দ্ব্যর্থদ্যোতকতার প্রসঙ্গে বলতে হয়: পথপ্রদর্শকের ঘনিষ্ঠ শিষ্যদেরকে এতো ভূয়সী রকমে নিদারুণ ত্রুটিপূর্ণ করে তৈরি করাটা ছিলো সুচারু এক কারিকুরি। তাদের কেউ কেউ—মুখকাটা পাজেউ, পেদ্রাও, আবট জুয়াও—হচ্ছে সাবেক ডাকাত আর গণহত্যাকারী; এমনকি দেখা যায় ‘জনমাতা’ পবিত্র মারিয়া কোয়াদ্রাদো হচ্ছেন একদা-কুখ্যাত ‘সালভাদোরের সন্তানহন্তা’; আর ঘনিষ্ঠতম যিনি শিষ্য, এই দঙ্গলের সন্ত পিটার, ‘খুদে ক্ষণজন্মা’ বলে যিনি পরিচিত, তিনি নিজেই যে-পবিত্র শপথ সকলকে করিয়েছিলেন এই মর্মে যে, মৃত পথপ্রদর্শকের সমাধিক্ষেত্রের কথা কখনোই কেউ প্রকাশ করবে না সে-শপথ ভঙ্গ করে শেষমেশ (পিটারের মতোনই) তিনি আপন খ্রিস্টের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এই দোষত্রুটি শিষ্যগণকে বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র হিশেবে গড়ে তোলারও অধিক কাজে আসে: চোখে আঙুল দিয়ে এসব দেখিয়ে দেয় যে, এই সৃষ্টিছাড়া অভ্যুত্থানের নেতারা তাদের অনুসারীদের চাইতে কোনো দিক দিয়েই উত্তম নন; নানাভাবে আরও মন্দ হওয়ায় তাঁরা নৈতিকতার অবতার হয়ে ওঠেন না। সেই দায়িত্ব বিশ্বাসী জনসাধারণের জন্যেই রাখা থাকে।
একটি দ্ব্যর্থদ্যোতকতা একটু কম প্রীতিকর। ব্যারন দে কানাব্রাভার পত্নী এস্তেলার প্রাণপ্রিয় নিবাস কালুম্বিকে বিদ্রোহীরা পুড়িয়ে দিলে তিনি উন্মাদ হয়ে যান, এবং পতনশীল সামন্তবাদীদেরকে ক্ষণিকের জন্যে দরদের যোগ্য চরিত্র বলে মনে হয়। এরপর ব্যারন যখন প্রিয়তমা এস্তেলার ঘনিষ্ঠ থাকার একরকম পন্থা হিশেবে তাঁর পত্নীর চাকরানিকে ধর্ষণ করেন তখন তিনি এর খেসারত রূপে পাঠকদের সহমর্মিতা একেবারেই খুইয়ে বসেন (আর অকপটে বলতে হয়, এই পাঠকের বেলায়, ব্যারনের স্রষ্টাও সেই সহমর্মিতা প্রায় খুইয়েই বসেন আর কী)। “আমার সবসময়েই ইচ্ছে ছিলো তোমার সাথে ওকে ভাগাভাগি করে নেবো, লক্ষ্মীটি,” তিনি “আমতা আমতা করে বলেন”, আর উন্মাদ এস্তেলা অমত করে না। চাকরানি সেবাস্তিনার মতামত জানতে চাওয়া হয় না৷ যে-বইখানি বীভৎসতম সময়েও সচরাচর অশিষ্টতা এড়িয়ে যায় সেই বইতে এটি কুৎসিত এক মুহূর্ত।
মহাপ্রলয়ের যুদ্ধ-এর রাজনৈতিক রূপকল্প নৈরাশ্যব্যঞ্জক, এবং ওই সম্যক নৈরাশ্যব্যঞ্জকতা নিয়ে তর্ক তোলা সম্ভব। তবে এই নৃশংস শতাব্দির শেষের দিকে এসে একজন লেখকের পক্ষে জীবন সম্পর্কে বিয়োগান্ত দৃষ্টিভঙ্গি না রেখে কুলিয়ে ওঠা কঠিন, আর মারিও বার্গাস ইয়োসা লিখেছেন সুবিশাল মাপের একটি আধুনিক বিয়োগান্ত রচনা, অবশ্য দয়া করে সাড়ম্বর ঢঙে লেখেননি। ৫৫০ পৃষ্ঠা শেষে, এ-বইয়ের মৃত্যু, অবক্ষয় ও বিশ্বাসের চিত্রায়ণে দু’টি চিত্রকল্প প্রাধান্য বিস্তার করে। একটি হচ্ছে অনুসরণপটু শিকারী রুফিনো আর নৈরাজ্যবাদী গালিলিও গল, যাদের প্রত্যেকেই একটি ভাবনার খানিকটা আজগুবি ভৃত্য তাদের একে-অপরকে রয়েসয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মারার চিত্রকল্প; বার্গাস ইয়োসার রাজনৈতিক রূপকল্পকে এটি স্ফটিকস্বচ্ছ করে তোলে বলেই মনে হয়। দ্বিতীয়টি হলো পরিত্রাণমূলক। কানুদোসে ত্রিশ হাজার মানুষ মারা যায়, আর যে-ঈশ্বর এরকম আত্মাহুতি দাবি করে সে-ঈশ্বরকে সংক্রামক ব্যাধির মতোন এড়িয়ে চলতে হয় এমন ভাবাটাই হতো সহজ। কিন্তু চৈতন্যের যে-ঔদার্য সারা উপন্যাসকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেই ঔদার্য নিয়েই বার্গাস ইয়োসা এমন একজনকে শেষ কথাটি বলার সুযোগ দিতে রাজি থাকেন, যে কিনা এ-কথা কবুল করে বসে আছে যে, ওই দুর্বিপাক ছিলো একপ্রকার মহাসার্থকতাও।
কানুদোসকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলার পরে বেঁচে যাওয়া মানুষদের বিহিত করতে করতে বিজয়ী সৈন্যরা যে-একজন নেতার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি তার সন্ধান জানতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। এক বৃদ্ধা কর্নেল মাসেদোকে জিগেস করে, আবট জুয়াওয়ের কী দশা হয়েছে তা তিনি জানতে চান কিনা, আর কর্নেল সাহেব উৎসুক হয়ে মাথা ঝাঁকান।
“বড়ো ফেরেশতারা তাকে উঠিয়ে বেহেশতে নিয়ে গেছেন,” জিভ দিয়ে টকটক করতে করতে বুড়ি বলে। “আমি দেখেছি ওনাদেরকে।”