ড্রাইভিং সিটে বসে কথা বলছিলাম পাশের দুই ইন্ডিয়ান সিপাহীর সঙ্গে। গুলি প্রথম এসে লাগে আমার ডান হাতের কনুইয়ে। স্টেনগান হাত থেকে নিচে পড়ে যেতেই আরও কয়েকটি গুলি লাগে তলপেটে।
Published : 12 Jan 2025, 05:02 PM
“সময়টা ১৯৬৩ সাল। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে আমরা রেজাল্টের অপেক্ষায়। আব্বা তখন বুক বাইন্ডার। চাকরি করতেন ঢাকার বাংলাবাজারে। থাকতেন নওয়াব বাড়িতে। আমি ওইসময় বেড়াতে যাই আব্বার কাছে। সঙ্গে ছিলেন দূরসম্পর্কের এক ভাই তালুকদার মজনু।
ঢাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। একদিন পরিচিত একজনের মুখে শুনি আর্মিতে লোক নেওয়ার সংবাদটি। ‘কাল আর্মিতে লোক ভর্তি করবে, যাবি তোরা’— আমরা রাজি হতেই জানিয়ে দেন ঠিকানাটি। ওইদিন সকালেই আমি আর মজনু রওনা দিই পলাশী ব্যারাকের দিকে। ওখানেই লাইন দিচ্ছিল সবাই।
আমরাসহ লাইনে ছিল পঞ্চাশ থেকে ষাট জন। এক সুবেদার বাছাই করছিলেন। আমাকে না নিয়ে তিনি আগে-পিছে অন্যদের নিয়ে নিচ্ছেন। নজরে পড়তে আমি আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এবারও আমাকে না নিয়ে অন্যদের নেওয়া হলো। আগের মতোই আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন সুবেদার বললেন, ‘কেন বারবার সামনে আসছ। তুমি বাচ্চা ছেলে, তোমাকে নেওয়া যাবে না।’
খুব রাগ হলো। আমি কইলাম, ‘আপনিও তো আমারই সমান। খাওয়া দাওয়া করেছেন বলে একটু মোটা হইছেন। কিন্তু আপনার হাইট তো আমার মতোই।’ আমার কথা শুনে তিনি হেসে দিলেন। দূরে বসে ঘটনাটি দেখছিলেন রিক্রুটিং অফিসার। আমাকে ডেকে তিনি বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করে বললেন, আর্মিতে কেন ভর্তি হতে চাও?
উত্তরে বললাম, ‘স্যার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিছি, রেজাল্ট হয় নাই। ওয়েস্ট পাকিস্তান দেখার খুব শখ।’ আমার কথা শুনে তিনি মুচকি হাসলেন। অতঃপর তিনি অর্ডার দিতেই আমার বুকে পড়ল সিল। যোগ দিলাম সিপাহী পদে। আমার আর্মি নম্বর: ৬৫৭৮১০৩।
প্রথমে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে পরে ঢাকার সিগন্যালে এবং সবশেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের ঝিলংয়ে। সেখানে নিই ছয় মাসের আর্মি ট্রেনিং।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় পঁয়ষট্টিতে। ট্রেনিং শেষে তখনই আমাদের কসম খাওয়ানো হয়। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিয়ালকোটে। ভারতীয় আর্মির বিরুদ্ধে ওখানেই আমরা যুদ্ধ করি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকলেও বাঙালিদের তারা উল্টো চোখে দেখত। ব্যারাকের ভেতর বৈষম্য ছিল অনেক। অফিসার পদে অধিকাংশ ছিল ওদের লোক।
সত্তরের নির্বাচনের পর আমি ছুটিতে বাড়ি আসি। দেশের অবস্থা তখন অন্যরকম। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ছুটি শেষ। তবুও আব্বা আমাকে যেতে দিলেন না। বললেন, ‘দেশের কন্ডিশন খারাপ। তোমার আর যাওয়া লাগবে না।’ আমি আব্বার কথা ফেলতে পারলাম না। বারবার চিঠি আসে, আমাকে বলা হয় রিপোর্ট করতে। কিন্তু আমি ঢাকাতেই থেকে যাই আব্বার কাছে।”
একাত্তর পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর খান। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা। পিতার নাম গোলাম রহমান খান এবং মাতা ছবিলা খাতুন। বাড়ি টাঙ্গাইল নাগরপুর উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামে। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে জাহাঙ্গীর ছিলেন সবার বড়।
বাল্যকালের স্মৃতি জানাতে তিনি বললেন যেভাবে, “এখনকার মতো তখন এত ক্লাব ছিল না। আমাদের ফুটবল ক্লাবটির নাম ছিল তেবাড়িয়া সলিমাবাদ স্পোর্টিং ক্লাব। তখন জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। একদিন বন্ধুরা বলে, আজকে যে গোলে হারাতে পারবে, তাদের খাওয়াতে হবে। কী খাবি তোরা? আলু-ভাত দিলেও খাব, ডাল-ভাতও খাব। সবাই আমরা রাজি হলাম। আমি যে দলে ছিলাম ওই দল সেদিন হারল। তাই সন্ধ্যায় সবাই মিলে বাজার করি। পাশেই যমুনা নদী। বড় যমুনার একটা শাখা। নৌকা ভাড়া করে নদীতে ঘুরলাম। খিচুড়ি আর মাংস রান্না হলো নৌকাতেই। খাওয়া শেষে হাত ধুতে গিয়ে নদীতে পড়ে যায় সানোয়ার। শীতের রাত্রে তার সারা শরীর ভিজে হয় চুপচুপে। এ নিয়ে আমাদের সেকি হাসাহাসি।”
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আর্মি নামার ঘটনা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর। তিনি বললেন যেভাবে, “২৪ মার্চ সারাদিনই নানা গুঞ্জন চলছিল। রাত বারোটার পর গুলির শব্দ পাই। সকালে দেখলাম যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে। আমরা ঢাকায় থাকি চার দিন। অতঃপর পায়ে হেঁটে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নবাবগঞ্জ হয়ে মানিকগঞ্জের ভেতর দিয়ে চলে আসি নাগরপুরে।’
মুক্তিযুদ্ধে কবে গেলেন?
“এপ্রিলের আটাশ তারিখ হিলি বর্ডার দিয়ে আমরা ওপারে যাই। আমার সঙ্গে ছিল পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। ইপিআর কাদেরের কথা এখনো মনে পড়ে। ভারতে বিএসএফ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। পাকিস্তানি আর্মির পে-বই দেখালে তারা আমাকে বাড়তি কদর করে। তাদের মুখে একবার খবর পেলাম কলকাতা পার্ক সার্কাসে এসেছেন ওসমানী সাহেব। তার সঙ্গে দেখা করতেই তিনি ২৪ জন ট্রেইনড সৈন্যের তালিকায় আমার নাম তুলে দেন। আমরা তখন ইন্ডিয়ান আর্মিদের পোশাক পরে তাদের সঙ্গে নানা কাজ করতাম। আর্মিতে আমি ড্রাইভারের কাজ করেছি।
কাজ ছিল ওদের ড্রাইভারদের সেকেন্ড সিটে বসে থাকা। ওরাই চালাবে। দরকার হলে আমরা কাজ করব। পরের দিন আমরা ইছাপুর অর্ডিনেন্স ফ্যাক্টরি থেকে গাড়ি নিয়ে প্রথম গোহাটি পরে শিলচর এবং শেষে আসি ধর্মনগরে। সেখানে গাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার ট্রেনে ফিরে আসি। এভাবেই চলছিল সময়টা।”
জাহাঙ্গীর একবার শিলচর ক্যান্টনমেন্টে এসে খোঁজ পান এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) ক্যাম্পের। ক্যাপ্টেন হায়দার সাহেব ছিলেন সেটার দায়িত্বে। তাকে পেয়ে তিনি খুশি হলেন। ভারতীয় মেজরের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন জাহাঙ্গীরসহ ট্রেইনড সেনাদের ২৪ জনের লিস্টটি। এরপর থেকেই দুই নম্বর সেক্টরে তারা সরাসরি কাজ করেন ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের ডান হাতের কনুইয়ের হাড়ের কিছু অংশ উড়ে যায় এবং কয়েকটি গুলি লাগে তার তলপেটে। সেদিনের ঘটনাটির কথা শুনি তার মুখেই।
তার ভাষায়, “আমি তখনো ইন্ডিয়ান ট্রুপসের সঙ্গে। পরিকল্পনা হয় আমাদের এফএফ ও ইন্ডিয়ান রেজিমেন্ট একসঙ্গে মুভ করে হালুয়াঘাট দখলে নেয়ার। ইন্ডিয়ান আর্মি পাঁচশর মতো আর এফএফ তারও বেশি।
২৮ নভেম্বর ১৯৭১। আমরা ছিলাম মেঘালয়ে। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। মেঘালয়ে পাহাড়ের এক জায়গায় নামে ইন্ডিয়ান ট্রুপস। ঢালের রাস্তা বেয়ে গাড়ি নিয়ে নামে তারা। একটি গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি। পাকিস্তানি সেনারা ছিল কংশ নদীর পশ্চিম পাড়ে। আমরা পূর্বপাড়ে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নেমে আসছি। ওপার থেকে হঠাৎ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়।
গুলির শব্দ হতেই ব্রেক করি। আগুনের মতো ফায়ার আসছিল। সবাই তখন গাড়ি থেকে নেমে যায়। সিগন্যালের মাধ্যমে ওরা যোগাযোগ করে ওয়্যারলেসে। আমি ড্রাইভিং সিটে বসে কথা বলছিলাম পাশের দুই ইন্ডিয়ান সিপাহীর সঙ্গে। গুলি প্রথম এসে লাগে আমার ডান হাতের কনুইয়ে। স্টেনগান হাত থেকে নিচে পড়ে যেতেই আরও কয়েকটি গুলি লাগে তলপেটে।
প্রথমে তেমন কিছু টের পাইনি। মনে হলো কেউ যেন আমার হাতে জোরে বাড়ি দিয়েছে। রক্ত পড়ছিল ঝরঝর করে। পাশে ছিল এক ইন্ডিয়ান জেসিও। সে একটা শার্ট দিয়ে আমার হাতটা পেঁচিয়ে দেয়। পেটে যে গুলি লেগেছে তখনো বুঝিনি। আমার সাথের দুজনও গুলিবিদ্ধ হয়। সারা শরীর হিম হয়ে আসছিল। আমাদের তুলে নিতে হেলিকপ্টার কল করা হয়। কিন্তু তার আগেই আমি জ্ঞান হারাই। ১ মাস ৮ দিন জ্ঞান ছিল না। যখন চোখ মেলি তখন আমি ব্যারাকপুর মেডিকেল হাসপাতালে।”
ডান হাতের জখম দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর জানান স্বাধীনতা লাভের পরেও হাত নিয়ে তার কষ্টের কথাগুলো। “হাতটাতে অপারেশন হয়েছে ২৬ বারেরও বেশি। ১৯৭৩ সালে সরকারিভাবে চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডে। সেখানেই হাতে স্ক্রু লাগিয়ে দেওয়া হয়। হাতটা ঝুলে ছিল কোনোরকমে। মাঝেমাঝেই ব্যথা হয়ে ফুলে যেত। তখন সারারাত বসে বসে কাঁদতাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সুইজারল্যান্ডে। কোনো এক সেমিনারে এসেছিলেন তিনি। সেদিনকার ছবি দেখলে আজও সবকিছু মনে পড়ে যায়।”
মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আক্ষেপ করে বলেন, “দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি সেটা আর বলতে চাই না। এত বছরে তো একটা লোক আসল না মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার খোঁজ নিতে। আজ তুমি আসলা। আমি তো ছেলেমেয়েরে বলেই দিয়েছি মরলে যেন কেউ বাসায় না আসে। মরণের পরে মুক্তিযোদ্ধার ওই সম্মান আমার দরকার নাই।”
স্বাধীন দেশে খারাপ লাগার কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “এখন ইলেকশন করেই সবাই জনগণের কথা ভুলে যায়। যে রাজা হয় তার পকেটেই টাকা যায়। কেউ ইলেকশনে খরচ করল ৩ কোটি টাকা। ক্ষমতায় গিয়ে সে টাকা না তুলে জনগণের কাজ করে না। দুই পয়সারও দেশপ্রেম দেখি না তাদের মধ্যে। যে যায় ক্ষমতায় সেই চুরি করে। সে কারণে দেশের উন্নতি হয় না। এসব দেখলে খুব খারাপ লাগে।”
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা অনুভূতির কথাও শুনি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের মুখে। তার ভাষায়, “নিজস্ব রাষ্ট্র আর ফ্লাগ পেয়েছি। খাইয়া থাহি না থাহি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। বিদেশি মিশনে আমাদের সৈনিকেরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। গার্মেন্ট সেক্টরের মা-বোনরা দেশের অর্থনীতিকে বদলে দিচ্ছে। এর চেয়ে ভালো লাগা আর কি হতে পারে!”
মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর খানের বন্ধুতা। তাদের তিনি বলেন, “ভালোভাবে লেখাপড়া করো। বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নয়, বরং ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো।”
মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের কাছেই নাতনি ফরিয়া, ফারহা, আদৃতা ও হৃদিতা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। তিনি তখন তাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। হৃদিতা তখন নানার হাতের একাত্তরের জখম দেখে। মলিনমুখে তাতে হাত বুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নানাকে প্রশ্ন করে, তোমার এখানে কে গুলি করল, নানু? পাকিস্তানিরা? ওদের আমি ছাড়ব না। কেন ওরা আমার নানুকে গুলি করল। নাতনির কথাগুলো শুনে বুক ভরে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের।
মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর খানকে নিয়ে লেখার আগেই গত ২৭ নভেম্বর তারিখে তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু আমাদের কাছে একাত্তরের বীরদের মৃত্যু নেই। তার বলা সকল কথা ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে। এমন আত্মত্যাগী বীরের ইতিহাসই একাত্তরের পথে উদীপ্ত করবে আগামী প্রজন্মকে।