‘‘আমি যেন ঠিক এক সাপ যার লেজটি তারই মুখের ভেতর ঢোকানো; একটু স্বচ্ছন্দ্য-সহকারে কবর দেওয়ার জন্য সামান্য অর্থ ছাড়া বছরের শেষে কিছুই জমা থাকার দরকার নাই।
Published : 13 Jan 2025, 11:56 PM
কে আর মৃত্যুর চিন্তা না-করে থাকতে পারে, কে আর তাতে অস্থির না হয়! জীবনানন্দ বলেছেন: ‘‘আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,/ সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে/ ধূসর মৃত্যুর মুখ।’’ স্যামুয়েল বেকেট ঠাট্টাচ্ছলে বলেছেন, মৃত্যু আমাদের একটি দিনকেও মুক্ত রাখতে চায়নি: death has not required us to keep a day free। মৃত্যু এক অনিশ্চিত-নিশ্চিততা: আসবে একদিন তা নিশ্চিত কিন্তু কবে, কখন, তা অনিশ্চিত।
মৃত্যু নিয়ে গ্রস্ত বা অবশিত হয়ে থাকে অনেকেই, এটা ভাবনার জলবায়ু যাতে ব্যক্তি বেঁচে থাকেন ভেবে না-ভেবেই, বা না-ভেবে ভেবেই। কিন্তু মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার দৃষ্টিবিভ্রমটা কেমন হয়? মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করা মানে মৃত্যুমুহূর্তকে প্রত্যক্ষ করা। মৃত্যু-মুহূর্তে বা মৃত্যুলগ্নে নাকি অনেকের সুড়ঙ্গবীক্ষণ ঘটে: তারা অন্ধকার এক সুড়ঙ্গ দ্যাখে যার ওধারে আলোর আভাস। দেহ থেকে দেহাতীত যাত্রার এ কোন ছায়াপথ সে দ্যাখে! ব্যক্তি নাকি দেহকে ফেলে রেখে সেই উজ্জ্বল আলোর ফুটকির দিকে ভেসে যেতে থাকে। আলোর প্রতীক তাকে ডাকে। পরীক্ষাগারে স্বাস্থ্যবানদের ওপর বিশেষ আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, কেউবা দৃষ্টিগত অমূলপ্রত্যক্ষণে আক্রান্ত হয়--তারা উজ্জ্বল আলো এবং রঙিন ছোপ দেখতে পায়, কারও কারও নতুন এক জগতে প্রবেশের উপলব্ধি হয়, কেউ কেউ অতিপ্রাকৃতিক সত্তার মুখোমুখি হয়। এ হয়তো এক আধ্যাত্মিক জগতের হাতছানি, সারা জীবন যাকে ব্যক্তি লালন করে গেছে তার চেতন-অবচেতনে। বিজ্ঞানমনস্করা কেউ কেউ বলেন যে মৃত্যুনৈকট্যকালে শরীর থেকে এনডোরফিন নামের এক প্রাকৃতিক মাদক নির্গত হয় যা ব্যক্তিকে একধরনের দৃষ্টিগত অমূলপ্রত্যক্ষণের মুখোমুখি করে। বিজ্ঞানীরা বলেন, পাইলটরা উচ্চমাত্রার জি ফোর্সের অভিজ্ঞতার সময় যখন ব্লেক আউটের সম্মুখীন হয় তখন চোখের রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রান্তস্থ দৃষ্টিআচ্ছন্নতায় আক্রান্ত হয় এবং তাদের সুড়ঙ্গবীক্ষণ ঘটে। অনেকে আবার মৃত্যুর আগেই নিজ মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে--সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে পাহাড়ে ভ্রমণে গিয়ে খাটিয়ায় নিজের লাশ দেখতে পেয়েছিলেন। বাসুদেব দাশগুপ্তর একটি গল্পে দেখা যায়, প্রোটাগনিস্ট দেখতে পায় যে সে মারা গেছে আর তাকে শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞান হয়তো একে বলে সংবেদনচ্যুতি বা সেনসরি ডিপ্রাইভেশন।
মৃত্যুর সময় কী দৃষ্টিদান হয় তা নিয়ে নানার্থ থাকলেও মৃত্যু নিয়ে ভাবে না, এমন মানুষ কি সত্যিই আছে? জীবনের দার্শনিকতা আর মৃত্যুর দার্শনিকতায় মানুষ আবিষ্ট থাকে, আচ্ছন্ন থাকে। এপিকুরুস বলেছেন, ‘‘মৃত্যু কিছুই না আমাদের কাছে। যখন আমরা বাঁচি মৃত্যু আসে না কাছে। যখন মৃত্যু আসে তখন আমরা আর থাকি না।’’ মৃত্যুভাবনাকে এপিকুরুস বাতিল করলেও ভাবনা নিশ্চয় তাঁকে গ্রাস করেছিল, যদিও তিনি ছিলেন ভোগবাদী। কিন্তু বারুক স্পিনোজা যা বলেছেন তা এক সাহসী কথা: ‘‘মুক্ত মানুষ সবকিছুর মধ্যে মৃত্যুকেই সবচেয়ে কম ভাবে, আর তাঁর প্রজ্ঞা মৃত্যুর নয়, জীবনের এক ধ্যান।’’ স্পিনোজা যে এ কথা বলেছিলেন তার পেছনে ছিল জীবনের দার্শনিক নীতিরক্ষায় তাঁর বিশ্বস্ত থাকার সচেষ্টতা। স্বভাবত তাঁর ছিল স্টোয়িক মন, আর ছিল সেই মনের একাগ্রতা। নৈতিকতা-বিষয়ে তাঁর বিচিন্তিত বা চূর্ণিত কোনো ভাবনা ছিল না, ছিল প্রতীতির সংহত এক অবস্থান। ঈশ্বরকে তিনি বলতেন: Natura naturans: naturing nature , প্রতিপালক প্রকৃতি: ক্রিয়াশীল, শাশ্বত, নিশ্চুপ মাত্রিকতা। দেকার্তের অধিবিদ্যার মতো তা নয় দ্বৈত। স্পিনোজার কাছে দেহ ও আত্মা অভিন্ন। আত্মা হলো জ্ঞান বা চিন্তন। দেহ হলো প্রকাশের ধরন, আত্মা হলো চিন্তার ধরন। ঈশ্বরের জ্ঞান হলো প্রকৃতিরই জ্ঞান। প্রকৃতির সমগ্রতার একটি অংশ হলো মানুষ যে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল, তার দ্বারা চালিত হয়, পরিত্রাণ ও মঙ্গলের জন্য যে নিজে কিছুই করতে পারে না। স্পিনোজার অধিবিদ্যার মূলসূত্র হলো Deau sive natura : God, or Nature| “divinize nature naturalize God”--এ-ই তাঁর দর্শনের প্রত্যয়। শাশ্বত আর অনন্ত সত্তা যাকে ঈশ্বর বলা হয়, বা প্রকৃতি, তা অস্তিত্বের অভিন্ন প্রয়োজনে কাজ করে চলে। জগৎ ঈশ্বরের সৃষ্ট নয় বরং অংশ এবং প্রকাশ, এই Immanence ধারণাই ছিল তাঁর। স্পিনোজার কাছে যেহেতু ঈশ্বর ও প্রকৃতি একাকার, সুতরাং তাঁর কাছে মৃত্যুভাবনা কোনো বিশেষ জায়গা নিয়ে নেয় না, বরং জায়গা ছেড়েই রাখে। সেই জায়গাটি হলো ভাবনামুক্তি। নিজ দার্শনিক প্রতীতিটি ছিল তাঁর জীবন-প্রতীতিও, ফলে মৃত্যু-বিষয়ে অতি ভাবনা নয়, নয় কোনো উন্মার্গতা, বরং একে একটি সাধারণ ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করা। তাঁর দর্শনচিন্তা অস্তিত্বচিন্তাকে প্রতিস্থাপিত করেছিল পুরোপুরিভাবে। জগৎ যদি ঈশ্বরের অংশ বা প্রকাশ হয় তবে জগৎজনেরা তো এক একজন ক্ষুদ্র ঈশ্বর বা ঈশ্বরকণা। তাহলে মৃত্যু তো ঈশ্বরকণার মূল ঈশ্বরে বিলীয়মানতা বই অন্য কিছু নয়! এই যে প্রেক্ষণ একে বলা যায় শাশ্বতসন্ধানসূত্র। ক্ষুদ্র বোধ থেকে বৃহত্তর ভাবনাবিন্দুতে স্থির হওয়ার দাওয়াই। মৃত্যু নিয়ে মানুষের যে উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা আর ভীতি, তা যদিও অনেকক্ষেত্রেই ধর্মসৃষ্ট, তবু তার প্রধান দার্শনিক কারণ, মনে হয়, অস্তিত্বহীনতা। মানুষ অস্তিত্বকে হারাতে চায় না। এমনকি সে তার পরিচিত পরিবেশ, অবস্থান এবং অপ্রাপ্তিকেও শিরোধার্য করে বেঁচে থাকতে চায়। সে প্রাপ্ত অবস্থাকে সহজে পরিবর্তনও করতে চায় না, চেনা অধিকারকে ছাড়তে চায় না। আর মৃত্যুর মতো অচেনা অধিকরণকে সে কী করে পছন্দ করতে চাইবে! এই ছেড়ে যাওয়ার অনিবার্যতা তার ভেতর হাহাকারের জন্ম দেয়। সারা জীবন সে এই হাহাকারকে অবদমিত করে চলে, এই অবদমন তাকে পাগলপারা করে রাখে গভীরে। অনেকে এসব আক্রমণকে প্রতিহত করতে নিজের রক্ষাব্যূহ তৈরি করে চলে--ধর্ম, জ্ঞান, প্রার্থনা বা ভুলে-থাকার মোহজাল বিস্তার করে, আত্মকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে চলে। স্পিনোজার চিন্তা এক্ষেত্রে নির্মোহ, আর অবদমনমুক্ত।
মৃত্যুর ঠিক আগের সাড়ে পাঁচ বছর তিনি ছিলেন ফান ডের স্পাইকের বাড়ির একতলে। একটি বিছানা, ওক কাঠের ছোটো একটি টেবিল, ত্রিপায়া কর্নার টেবিল, দুটি ছোটো টেবিল, চশমার কাচ পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতি, আর বুককেসে একশ পঞ্চাশটি বই। দেয়ালে কালো ফ্রেমে বাঁধানো একটি পোর্ট্রেট, আর একটি দাবাখেলার বোর্ড। সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে তৃপ্ত ছিলেন তিনি, প্রায়ই গৃহসঙ্গীকে বলতেন: ‘‘আমি যেন ঠিক এক সাপ যার লেজটি তারই মুখের ভেতর ঢোকানো; একটু স্বচ্ছন্দ্য-সহকারে কবর দেওয়ার জন্য সামান্য অর্থ ছাড়া বছরের শেষে কিছুই জমা থাকার দরকার নাই। আমার আত্মীয়রা আমার কাছ থেকে কিছুই পাবে না যেমনটা আমিও পাই না তাদের কাছ থেকে কিছুই।’’ খুব নিরুদ্বেগ আর অনুত্তেজিতভাবে জীবন চালাতেন তিনি। মাকড়সা ধরে দুটির মধ্যে পরস্পর যুদ্ধ লাগিয়ে অবসরের আনন্দ উপভোগ করতেন তিনি, আর হেসে উঠতেন। কী যে সরল আর শিশুশুলভ এসব কিছু! অনেকেই আসত তাঁর কাছে, এমনকি সম্ভ্রান্ত ঘরের তরুণীরাও। কখনও আনন্দিত বা দুঃখিত হতেন না যা ছিল তাঁর নির্বিকারত্বের প্রধান লক্ষণা।
তাঁর অভিসন্ধিটি ছিল, প্রেক্ষণ হবে শাশ্বতের পরিপ্রেক্ষিতে--সুব স্পেসি এতেরনিতাতিস: sub specie eternitatis । তিনি দেখেছেনও এভাবে। শাশ্বত এখানে চিরন্তন, অজানা, সামগ্রিকতা। শাশ্বতের সাপেক্ষে দেখা, অনুভব করা, বিবেচনা করা।
তাঁর মৃত্যুটি অনুধাবনীয় ছিল না, অনুধাবিত হয়নিও। তেমন কোনো উপসর্গই ছিল না, শুধু কাশি ছিল তাঁর। যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির গৃহকর্তা ফান ডের স্পাইক আর তার পরিবার জানিয়েছিলেন, যে, তিনি যে জীবনের শেষপ্রান্তে চলে এসেছিলেন তা তারা বুঝতেই পারেননি, এমনকি মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তা তাদের কাছে সামান্যতও অনুমানগ্রাহ্য হয়নি; অনেকটাই রহস্যে মোড়ানো ছিল তাঁর চলে যাওয়াটা। স্পিনোজার অসুস্থতা চাপা ছিল, হয়তো তিনি নিজেও ছিলেন মৃত্যু নিয়ে অপ্রস্তুত, ভাবনাহীনও। অসুস্থতার উপলব্ধিকেও পাত্তা দিতেন না তিনি স্টোয়িকসুলভ ঔদাসীন্যে।
কোনো ইচ্ছাপত্রও রেখে যাননি, তবে ফান ডের স্পাইককে বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর পরই যেন তাঁর লেখা এথিকা এবং চিঠিপত্র আমস্টারডামে প্রকাশক য়ান রিউভের্টশ-এর নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ছিলেন অতিমাত্রায় আত্মদর্শী। নিজ দর্শন এবং চিন্তার নিষ্ঠতা ও বিশ্বস্ততায় তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন : a free man thinks least of all of death, and his wisdom is a meditation on life, not on death.
জীবনের তাৎপর্য এবং মহনীয়তার প্রশ্নে এর চেয়ে দৃঢ়, এবং চির, এবং থির কথামৃত আর কী হতে পারে?