১৯১৬ সালে তাঁর প্রথম জাপান আগমন উপলক্ষে অমূল্য এক স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “সেই তাগো-রু” (সন্ত টেগোর) নামে।
Published : 16 Mar 2025, 10:10 PM
জাপানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইতিহাস সুদীর্ঘ। এদেশে তাঁর বহুবিধ পরিচিতি বা ভাবমূর্তি বিদ্যমান, যেমন কবি, সন্ত, ঋষিকবি, সাহিত্যিক, শিশুসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সঙ্গীতরচয়িতা, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রকৃতিবিজ্ঞানী, ধর্মসংস্কারক, শান্তিবাদী, প্রাচ্যবাদী, স্বাধীনতাকামী, জাতীয়তাবাদী, জমিদার ইত্যাদি। তাঁর এসব দিক নিয়ে জাপানিরা চিন্তা এবং গবেষণা করে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও মতামত লিখে আসছেন শতবর্ষের অধিক সময় ধরে। বিপুল মুদ্রিত দলিলপত্র এই দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যা বিস্ময়কর! রবীন্দ্রনাথ-জাপান সম্পর্ক নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাপক গবেষণা হলেও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজ পর্যন্ত লিখিত হয়নি। রবীন্দ্র-জাপান সম্পর্ক জাপানে কোথাও পাঠ্য বলেও জানা নেই। জাপান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অন্তর্ভুক্ত আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাসম্পন্ন জাপান গবেষণা কেন্দ্রে।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্বের যে-কোনো জাতির চেয়ে জাপানিরাই সবচেয়ে বেশি মাতামাতি ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু কর্মকাণ্ড ও বিপুল দলিলপত্রই তার অকাট্য প্রমাণ। এর কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জাপানি ভক্তরা যা পেয়েছেন তা মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায়, যেমন, তাঁর সাহিত্যে রয়েছে শ্বাশত শান্তির কথা, উপনিষদের প্রভাব, বৌদ্ধচিন্তা, প্রাচীন ভারতের প্রভাব, বিশ্বমানবতা, মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, প্রকৃতিবন্দনা, নদীমাতৃক বাংলার বিচিত্ররূপ, মহাজাগতিক অনুভূতি, আধ্যাত্মিকতা, সুন্দরের আরাধনা, মৃত্যুচিন্তা, ঈশ্বরভাবনা ইত্যাদি। তাঁর দর্শনতত্ত্বে রয়েছে মানুষকে ভালোবাসা, বৈষম্যহীনতা, নিজেকে জানা এবং মৃত্যুকে নির্ভয়ে জয় করা। তাঁর চিন্তায় মহাপ্রকৃতি ছিল মাতৃস্বরূপ--মাতা যেমন সন্তানকে তার শৈশবে দৈহিক এবং সাবালক হলে পরে মানসিক শক্তিতে উজ্জীবিত করে, প্রকৃতিও তেমনি। তাই খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক শতবর্ষী জাপানি চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গবেষক ও শতাধিক গ্রন্থের লেখক ডাঃ হিনোহারা শিগেআকি রবীন্দ্রনাথকে “শিজেন কাগাকুশা” বা “প্রকৃতিবিজ্ঞানী” বলে অভিহিত করেছেন। তরুণকালেই তিনি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং আমৃত্যু গবেষণা করেন। তাঁর রচনা এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও রচনা থেকে নির্বাচিত অংশ উদ্বৃত করেছেন। চারদেয়ালের শৃঙ্খল থেকে প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শিশুশিক্ষার অভিনব চিন্তা থেকে সাহিত্যচর্চা, কুটিরশিল্প, বিজ্ঞানচর্চা, সঙ্গীতচর্চা, শারীরচর্চা, শিল্পকলা, নৃত্যচর্চা, নারীমুক্তি ইত্যাদি শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে যেভাবে তিনি প্রচলন করেছিলেন সারাবিশ্বেই তা ছিল এক কথায় ব্যতিক্রম ও আদর্শিক, তাই শান্তিনিকেতন ছিল জাপানিদের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি ও বৈশ্বিক শান্তি আরাধনার অভীষ্ট আশ্রম। অতীতে তো বটেই আজও শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ জাপানে সমার্থক। জাপানেও শিশুশিক্ষার মডেলস্বরূপ শান্তিনিকেতন গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও তামাগাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ড. ওবারা কুনিয়োশি এবং পিটার ব্রুকস পরিচালিত “মহাভারত” থিয়েটারের আবহসঙ্গীত রচয়িতা বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ৎসুচিতোরি তোশিয়ুকি।
বিশিষ্ট জাপানি নাগরিকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে
রবীন্দ্রনাথের প্রতি এভাবে আকৃষ্ট হওয়া বা তাঁকে আবিষ্কার করার পেছনে রয়েছে একজন বিশিষ্ট জাপানি মনীষীর প্রভাব এবং একটি অচিন্তনীয় ঘটনা। তিনি ওকাকুরা কাকুযোও তেনশিন। বিংশ শতকের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথেরও আগে বহির্বিশ্বে তিনি সুপরিচিত প্রাচ্যভাতৃবাদী তথা প্যান-এশিয়ানিস্ট এবং প্রাচ্যের প্রবুদ্ধ শিল্পকলাবিদ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের “গীতাঞ্জলি”রও আগে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে লন্ডন থেকে তাঁর প্রথম গ্রন্থ “ The Ideals of the East with Special Reference to the Art of Japan ”, যে গ্রন্থের প্রথম বাক্যটিই ছিল কালজয়ী “ Asia is One ”. এই বাক্যবন্ধটি ওকাকুরা স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতায় প্রদত্ত “ All religions are one ” দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে প্রবলভাবে মনে করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ কারাশিমা নোবোরু। পরের বছর ওকাকুরার দ্বিতীয় গ্রন্থ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয় “ The Awakening of Japan ”, ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক থেকে “ The Book of Tea ”---তিনটি গ্রন্থই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে আমেরিকা ও য়োরোপে। “দি বুক অফ টি” এপর্যন্ত কমপক্ষে ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত আধুনিক চিত্রশিল্পী জর্জিয়া টোট্টো ও’কিফি; স্থপতি, ডিজাইনার, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ফ্রাঙ্ক লয়ড রাইট, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক, চা-সেবী সকলের কাছে এই গ্রন্থটি বাইবেলস্বরূপ। ওকাকুরাসুহৃদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাহাজে পড়তে পড়তে প্রথম জাপানে আগমন করেন ১৯১৬ সালে।
আধুনিক জাপানের মেইজি যুগে (১৯৬৮-১৯১২) রাজধানী টোকিওর উয়েনো শহরে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারিভাবে টোকিও চারুকলা ও টোকিও সঙ্গীত বিদ্যালয় ( Tokyo Fine Arts School and Tokyo Music School , বর্তমানে Tokyo University of the Arts ) ১৮৮৭ সালে বিদেশ প্রত্যাগত ওকাকুরার সহযোগিতায়। উক্ত বিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ওকাকুরা তেনশিন। কিন্তু একাধিক ঘটনার কারণে তাঁকে অপসারণ করা হয়, অথবা তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ১৮৯৭ সালে। এর মাস ছয়েক পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন উয়েনোর কাছেই ইয়ানাকা উপশহরে “নিহোন বিজুৎসুইন” (জাপান চারুকলা ইনস্টিটিউট) তাঁর একাধিক শিষ্য চিত্রশিল্পী এবং পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ে। ১৯০১ সালের শেষ দিকে ভারত ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ হন স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকান শিষ্যা মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের দ্বারা। পরের বছর জানুয়ারি মাসে মাদ্রাজ হয়ে কলিকাতায় যান ওকাকুরা। গঙ্গাতীরবর্তী বেলুড় মঠে সাক্ষাৎ করেন স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে। আসার আগেই চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছিল দুজনের। সাক্ষাতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ওকাকুরাকে প্রাচ্যের হারিয়ে যাওয়া ভাই বলে অভিহিত করেন স্বামীজি, দুজনেই তখন সমবয়সী। স্বামীজিই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ওকাকুরাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বে বাঁধা পড়েন ওকাকুরা। বাঁধা পড়েন ওকাকুরার “দাইআজিয়াশুগি” (প্রাচ্যভাতৃবাদের) সঙ্গেও। সেই তো সূচনা জাপান-বাংলা তথা জাপান-ভারত শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ভাববিনিময় সম্পর্কের কলিকাতার মাটিতে ১৯০২ সালে। যদিও বা প্রকৃত সূচনা হয়েছিল ১৮৭৮ সালে মেইজি সম্রাট মুৎসুহিতো এবং রবীন্দ্রনাথের রক্তের আত্মীয় সঙ্গীতগবেষক রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মধ্যে বাদ্যযন্ত্র বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। যাহোক, রবীন্দ্রনাথের উপনিষদপ্রভাবিত প্রাচ্যাদর্শ ও শিক্ষাচিন্তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেন ওকাকুরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম বিদেশি ছাত্র হিসেবে ওকাকুরার ভ্রমণসঙ্গী তরুণ বৌদ্ধভিক্ষু হোরি শিতোকুকে রেখে দেন।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তোওয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে
প্রায় দশ মাস ভারতে অবস্থানকালে প্রায় সমগ্র ভূখণ্ডই পরিভ্রমণ করেন ওকাকুরা। ভ্রমণের মধ্য দিয়ে ভারতকে পর্যবেক্ষণ করার কারণ দেখিয়ে মেইজি সরকারের তহবিল থেকে পথখরচ বের করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কী কারণে ওকাকুরা হঠাৎ করে ভারত ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন সে এক রহস্য বই কি! শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনের মতো একদা প্রাচীন রাজধানী কিয়োতো শহরে প্রাচ্য ধর্ম মহাসম্মেলন করার জন্য স্বামীজিকে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন কি? নাকি স্বধর্ম বৌদ্ধধর্মের উৎস অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন? নাকি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন প্রত্যক্ষ করতে গিয়েছিলেন বলা কঠিন। স্বামীজির শিষ্যা মিস জোসেফিন কি আসলেই শিল্পকলা বিষয়ে জানার জন্য জাপানে এসেছিলেন? শিল্পাচার্য ওকাকুরার নামই বা কীভাবে জেনে তাঁর কাছে এলেন সেই রহস্যও আজও উদঘাটন হয়নি। যদি স্বামীজির কাছ থেকে জেনে থাকেন, তাহলে স্বামীজি ওকাকুরার নাম জানলেন কীভাবে? কেনই বা জোসেফিন ওকাকুরাকে ভারত ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করবেন সেও এক জিজ্ঞাসা হয়ে রয়েই গেল। এর পেছনে কি ব্রিটিশ কর্তৃক শোষিত, নির্যাতিত ভারতের প্রতি তৎকালীন “ফ্রি মেসনারি”দের সহানুভূতি ছিল? মার্কিন নাগরিক মিস জোসেফিন কি এই গুপ্ত সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন? স্বামীজি তো ফ্রি মেসন গুপ্ত সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
ওকাকুরা ভারতে গিয়েই বিপ্লবী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হলে মিসেস সারা সি.টি.বুল তথা ধীরামাতার প্রদত্ত সান্ধ্যসমাবেশে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতের ব্যাপারে তিনি কী ভাবছেন? থতমত খেয়েছিলেন আকস্মিক এই প্রশ্নে সুরেন্দ্রনাথ! ক্রমে জড়িয়ে গেলেন স্বাধীনতাকামী তরুণ স্বদেশিদের আন্দোলনে ওকাকুরা। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষসহ একাধিক বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তাঁরই পরামর্শে জাপানি রীতিতে গুপ্ত রাজনৈতিক সংস্থা “অনুশীলন সমিতি” গড়ে উঠেছিল ১৯০২ সালেই ওকাকুরার ভারতে অবস্থানকালে বিপ্লবীদের ভাষ্য থেকে জানা যায়। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রভূত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু কর্তৃক ১৮৮১ সালে গঠিত “গেনয়োওশা” গুপ্ত রাজনৈতিক সংস্থার কথা ওকাকুরা বিলকুল জানতেন। গেনয়োওশার মতোই গুপ্ত কর্মকাণ্ড ছিল অনুশীলন সমিতির।
স্বাধীনতাকামী পরাধীন ভারতীয়দের প্রতি ওকাকুরার সহানুভূতি এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য বুলেটিনও প্রকাশ করেছিলেন নিজব্যয়ে, যা তাঁর প্রধান শিষ্য চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়। এই ঘটনা ব্রিটিশ সরকারকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল। প্রখর নজরদারি ও প্রবল চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ওকাকুরা ভারতত্যাগ করতে বাধ্য হন। জাপানে প্রত্যাবর্তনের সময় কলিকতার “মল্লিক” পদবিধারী এক ব্যবসায়ী পরিবারের এক কিশোরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, তাকে জাপানি ভাষা ও জুদোও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরের বছর ১৯০৩ সালে প্রধান দুই শিষ্য চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসোওকে যখন কলিকাতায় পাঠান তখন ওই কিশোর তাঁদের সহযাত্রী হয়। ত্রিপুরা রাজ্যে সদ্যনির্মিত রাজপ্রাসাদে দেয়ালচিত্র অঙ্কনের কাজ করার কথা ছিল তাঁদের। রবীন্দ্রনাথ ওকাকুরাকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয়নি। মাস তিনেক দুজন ঠাকুর পরিবারের অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার প্রমুখ শিল্পীদের সঙ্গে শিল্পকলাবিষয়ক মতবিনিময় এবং কলিকাতা শহর ভ্রমণ করে কাটিয়ে জাপানে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য যে, বেশ অর্থসঙ্কটে পড়ে গেলে জাপানি শিল্পীদ্বয় তাঁদের অঙ্কিত চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করে বেশকিছু ছবি বিক্রির অর্থ দিয়ে জাহাজের টিকিট কিনেছিলেন। কলিকাতায় অবস্থানকালে দুজন অনেক ছবি অঙ্কন করেছিলেন, যার বেশকিছু দিয়ে জাপানে প্রদর্শিত হলে পরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
ওকাকুরা ফিরে এসে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন, তাতে উপস্থিত শতের কাছাকাছি বিভিন্ন শ্রেণীর বিশিষ্টজনের সম্মুখে ভারত পর্যবেক্ষণের কথা বলেন। ১৯১২ সালে বোস্টন থেকে ভারতে যান আবার। পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটে পুরনো বন্ধু রবীন্দ্রনাথসহ অনেকের সঙ্গে। এক সমাবেশে পরিচিত হন রবীন্দ্রনাথের স্বজন চল্লিশ বছর বয়সী বিদুষী মেধাবী বিধবা প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, এবং প্রথম দেখাতেই দুজনের প্রেমজ সম্পর্কের জন্ম হয়। অনেকগুলো চিঠি আদানপ্রদান ঘটে তাঁদের মধ্যে। ওকাকুরার মৃত্যুর পর এই নিষ্কাম প্রেমের আবিষ্কার ঘটে ওকাকুরার অনুজ ওকাকুরা য়োশিসাবুরোও কর্তৃক। প্রিয়ম্বদাদেবীকে লিখিত চিঠি থেকে জানা যায় ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথকে তিনি কতখানি অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন। জাপানিরা সাধারণত পদবি ধরে সম্বোধন করে থাকেন। জাপানিরা রবীন্দ্রনাথকে “তাগো-রু” (টেগোর) বলে সম্বোধন করতেন বা লিখতেন কিন্তু ওকাকুরা “বাবু রবীন্দ্র” বলে সম্বোধন করেছেন অনন্ত দুটি চিঠিতে। ১৯১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে প্রিয়ম্বদাদেবীকে লিখিত দীর্ঘ একটি চিঠির শেষ দিকে লিখেছেন:
“ I have seen something of Babu Rabindra this last week. His son and daughter-in-law have just left me. They are all leaving for Chicago tomorrow. I am afraid America was trial to your uncle—he was happier perhaps in London and of course, his true place is in India .” এর বছর চারেক পর ১৯১৭ সালে আমেরিকা কুখ্যাত “হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রে”র একজন কুচক্রী হিসেবে নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছিল! এতে ওকাকুরার দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বন্ধু হারা তোমিতারোওর সঙ্গে (বাঁদিক থেকে দ্বিতীয়) রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে
কলিকাতায় অদ্ভুত প্রতিমূর্তি ওকাকুরার সান্নিধ্যে এসে জাপানের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাপানকে দেখা ও জানার জন্য প্রবলভাবে উৎসুক হয়ে পড়েন তিনি, যখন পূর্বোক্ত দুই শিল্পী, জুদোও প্রশিক্ষক সানো জিননোসুকে, চিত্রশিল্পী কাৎসুতা শৌকিন, দারুশিল্পী কৌনো, কাসাহারা কিনতারোও, বৌদ্ধপণ্ডিত-ভিক্ষু কাওয়াগুচি একাই, বৌদ্ধপণ্ডিত কিমুরা রিউকান, ভারতবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড.তাকাকুসু জুনজিরোও প্রমুখকে ভারতে পেয়েছিলেন ওকাকুরার কল্যাণে। ক্রমাগত সুযোগ খুঁজছিলেন জাপান ভ্রমণের। সেই সুযোগ মিলল ১৯১৬ সালে। পরম সুহৃদ ওকাকুরার প্রয়াণের কিছুদিন পরে ১৯১৩ সালেই রবীন্দ্রনাথ এশিয়ায় প্রথম নোবেল বিজয়ী হলে পরে জাপান, কোরিয়া ও চিনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নজিরবিহীন আগ্রহী হয়ে ওঠেন জাপানের সাধারণ, অভিজাত এবং ধর্মীয় স্তরের নাগরিকবৃন্দ। প্রবল প্রতাপশালী শিল্পপতি, প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা আধুনিক জাপান রাষ্ট্র নির্মাতার প্রথম উদ্যোক্তা শিবুসাওয়া এইইচি আমন্ত্রণ জানান রবীন্দ্রনাথকে বলে কথিত আছে, তখন তিনি ১৯০৩ সালে গঠিত “জাপান-ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনে”র তৃতীয়তম প্রেসিডেন্ট। নজিরবিহীন বিপুল সংবর্ধনা ও অভ্যর্থনায় ভেসে যান রবীন্দ্রনাথ। শিবুসাওয়া তো বটেই, তৎকালীন জাপানের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে যেমন, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রী ব্যারন ওওকুমা শিগেনোবু, কৃষিমন্ত্রী কোওনো হিরোনাকা, শিক্ষামন্ত্রী ড.তাকাতা সানায়ে, টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ইয়ামাকাওয়া কেনজিরোও, সিল্ক ব্যবসায়ী ও শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হারা তোমিতারোও, জাপান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট সোয়েদা জুউইচি, হোটেল নিউ গ্রান্ড এর কর্ণধার নোমুরা য়োওজোও, সাংবাদিক ও ইংরেজি হেরাল্ড অফ এশিয়া পত্রিকার প্রকাশক জুমোতো মোতোসাদা, কেইওগিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কামাতা এইকিচি, জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ড.নারুসে জিনজোও, দৈনিক আসাহি শিম্বুন পত্রিকার মালিক মুরায়ামা রিয়োওহেই, আন্তর্জাতিক কবি নোগুচি য়োনেজিরোও, বৌদ্ধপণ্ডিত মোকুসেন হিয়োকি, টোকিওর মেয়র ওকুদা য়োশিতোসহ অগণন। টোকিওর উয়েনো শহরস্থ বিখ্যাত কানয়েইজি বৌদ্ধমন্দিরে এক নজিরবিহীন সংবর্ধনা প্রদান করা হয় কবিগুরুকে, তাতে তিনশ জনের মতো বিশিষ্ট নাগরিক উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এই ভ্রমণের সময় টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় জাপানের উগ্রজাতীয়তাবাদ, পাশ্চাত্য-সংস্কৃতির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি এবং আগ্রাসী সমরবাদের কঠোর সমালোচনা জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় মহলে প্রবল প্রতিক্রিয়ার ঝড় তোলে। অনেক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ভিক্ষু-পুরোহিত, রাজনীতিবিদ তাঁর বক্তৃতার তাৎক্ষণিক তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা যেমন করেন পত্রপত্রিকায় লিখে, সাক্ষাৎকারে; অন্যদিকে কিছু সংখ্যক যথেষ্ট প্রশংসা করতেও দ্বিধা করেননি। বিপক্ষে-পক্ষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ফরাসি দার্শনিক আঁরি বের্গস-এর শিষ্য নাকাজাওয়া রিনসেন, একই দার্শনিকের অনুবাদক তেৎসুজি হিরোশি, সাংবাদিক-প্রকাশক-সম্পাদক কুরোইওয়া শুউরোকু, সাংবাদিক মিৎসুই কোওশি, কবি, নাট্যকার, শিশুসাহিত্যিক আকিতা উজাকু, সাহিত্যিক ও রবীন্দ্রঅনুবাদক য়োশিদা গেনজিরোও, সাহিত্যিক ও শিশুসাহিত্যিক ওগাওয়া মিমেই, লেখক কাতোও কাজুও, কবি ও আধুনিক হাইকু লিখিয়ে কাওয়াহিগাশি হেকিগোতোও প্রমুখ। ইংরেজিতে সুপণ্ডিত প্রভাবশালী কবি ও উপন্যাসিক নাৎসুমে সোওসেকি এই বিষয়ে কিছুই বলেননি। অবশ্য এর পরপরই এই উষ্মার কিছুটা প্রশমিত করেন রবীন্দ্রনাথ কেইওগিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে “স্পিরিট অব জাপান” শীর্ষক জাপানের আত্মশক্তিবিষয়ক বক্তৃতা দিয়ে। তাতে জাপানিদের সৌন্দর্যবোধ, নান্দনিকতা এবং আত্মশক্তির প্রভূত প্রশংসা করেন তিনি।
প্রথম ভ্রমণে বিভিন্ন স্থান তিনি পরিভ্রমণ করেন। নাগানো প্রদেশে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা-ক্যাম্পাসে কয়েকদিন কাটান ছাত্রীদের সান্নিধ্যে। মগ্ন হন সবুজ বনরাজিতে গভীর ধ্যানে। বিদায় নেবার সময় কাঁদিয়ে যান ছাত্রীদেরকে। ভুলে যাননি বন্ধু ওকাকুরার কথা। তাঁর বিধবা পত্নী ও পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কয়েকটি দিন কাটান ইবারাকি-প্রদেশের ইজুরাস্থ তেনশিন ভিলায়। নাগরিক সংবর্ধনা সভায় ভূয়সী প্রশংসা করেন ওকাকুরার। দশদিন ছিলেন টোকিওতে সুহৃদ শিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের বাড়িতে। তারপর প্রায় তিন মাস আতিথেয়তা গ্রহণ করেন বন্দরনগরী য়োকোহামাস্থ নয়নাভিরাম নান্দনিক সবুজসমৃদ্ধ “সানকেইএন” বাগান বাড়িতে। সে আরেক অনন্য ইতিহাস জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কের সুদীর্ঘ ইতিহাসের মধ্যে।
এখানে স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান ভ্রমণ এশিয়ার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ববহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর এই ভ্রমণকে কেন্দ্র করে দুর্ধর্ষ ভারতীয় তরুণ বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জাপানে আগমন। যাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন প্রভূত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব “গেনয়োওশা” গুপ্ত সংস্থাখ্যাত প্যান-এশিয়ানিস্ট গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু। তোওয়ামা, উচিদা রিয়োওহেই, ওওকাওয়া শুউমেই, নাকামুরা তেনপু, সোওমা আইজোওসহ আরও কতিপয় বিশিষ্ট নাগরিক এবং ভারতের স্বাধীনতাকামী প্যান-এশিয়ানিস্টদের উদার সাহায্য-সহযোগিতায় রাসবিহারী বসু স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মকাণ্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকা রাখেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাসবিহারী বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত ও সমর্থকরাই ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা, আর্থিক সমর্থন ও আন্দোলন গঠনে অসামান্য ভূমিকা ও অবদান রেখেছিলেন। যা বাঙালি জানে না বললেই চলে।
১৯১৭ সালে আমেরিকা থেকে স্বদেশ ফেরার পথে জাপানে বিরতি নিয়ে কিছুদিন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তেমন আলোড়ন সৃষ্টি না হলেও, তাঁর ভক্তের সংখ্যা হ্রাস পায়নি। ক্রমশ বেড়েছে। ১৯২৪ এবং ১৯২৯ সালেও রবীন্দ্রনাথের আরও তিনবার জাপানে আগমন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, তাঁকে নিয়ে জাপানিদের নজিরবিহীন মাতামাতি ১৯১৬ থেকে আজ পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়নি বললে অত্যুক্তি হয় না। তাঁকে নিয়ে অগণিত জাপানিদের বিপুল কর্মযজ্ঞই এই মন্তব্যের ক্ষেত্রে অকাট্য প্রমাণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
২০২০ সালে সাসাকি মিকা পরিচালিত ইন্টারনেটে মুক্তিপ্রাপ্ত টেগোর সঙস প্রামাণ্যচিত্র
১৯১৬ সালে তাঁর প্রথম জাপান আগমন উপলক্ষে অমূল্য এক স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “সেই তাগো-রু” (সন্ত টেগোর) নামে। ১৯১৫ সালে প্রথম “গীতাঞ্জলি” অনুবাদ করেন তরুণ সাহিত্যিক মাসিনো সাবুরোও। যদিও ১৯১৪ সাল থেকেই তাঁর কবিতার জাপানি অনুবাদ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত গীতাঞ্জলি এগারো বার অনুবাদ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মবর্ষ স্মারক গ্রন্থে সাত জন বিশিষ্ট জাপানি প্রবন্ধ লিখেছেন, যথাক্রমে ধর্মতত্ত্ববিদ, লেখক ও অধ্যাপক ড.আনেসাকি মাসাহারু, আন্তর্জাতিক কবি ও শিক্ষক নোগুচি য়োনেজিরোও, রাজনীতিবিদ ও প্রধানমন্ত্রী ব্যারন ওওকুমা শিগেনোবু, কবি, সাহিত্যিক ও অনুবাদক ওজাকি কিহাচি, কবি, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ড.ইনোউয়ে তেৎসুজিরোও, কবি, সাহিত্য গবেষক, জার্মান ও ফরাসি সাহিত্য গবেষক, অনুবাদক ও অধ্যাপক কাতায়ামা তোশিহিকো এবং কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও নাট্যকার সানেআৎসু মুশাকোওজি। এই ঘটনা জাপানের বৌদ্ধিকমহলে রবীন্দ্রনাথের বিপুল গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকেই নির্দেশ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়ার গ্রাফিক “ফ্রন্ট” ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত “প্রার্থনা” কবিতাটি ব্যবহার করেছে জাপানি ইম্পেরিয়াল সেনাবাহিনী। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ফরাসি সাহিত্যানুরাগী কাসে শোওজিরোও কর্তৃক আপোরোনশা প্রকাশনা সংস্থা থেকে ৮ম খণ্ডে রবীন্দ্ররচনাবলি প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সাল থেকেই শিক্ষাবিদ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ, নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক, শান্তিবাদী আন্দোলনের অগ্রদূত এবং জাপানে আধুনিক প্রকাশনার পথিকৃৎ শিমোনাকা ইয়াসাবুরোওর উদ্যোগে এবং রবীন্দ্রসুহৃদ কাগজ ব্যবসায়ী শিক্ষাবিদ ড.ওওকুরা কুনিহিকোর নেতৃত্বে “টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন” গঠন এবং উক্ত সংগঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় প্রচুর সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রবীন্দ্ররচনার অনুবাদ, স্মারক প্রকাশনা এবং রবীন্দ্রচিত্রকর্মের প্রদর্শনী ইউনেসকোর সহযোগিতায় ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক বহুশ্রুত নাম দেশিকোত্তম অধ্যাপক কাজুও আজুমা গঠন করেন “জাপান-ভারত রবীন্দ্র সংস্থা”, এবং রবীন্দ্রনাথের নারীভক্ত দোভাষী, অনুবাদক, গবেষক ও মনস্তত্ত¡বিদ মাদাম ড.কোওরা তোমি, ভারতীয় দর্শনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড.ৎসুওশোও বিয়োওদোও, ভারততত্ত¡বিদ অধ্যাপক ড.নাকামুরা হাজিমে প্রমুখের সহযোগিতায় একাধিক বড়মাপের কাজ সম্পাদন করেন, যেমন, ১৯৯৩ সালে ১২ খণ্ডে রবীন্দ্ররচনাবলি প্রকাশ, ১৯৯৪ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন “নিপ্পন ভবন” তথা জাপান ভবন জাপানবিষয়ক শিক্ষা অনুষদ স্থাপন। তাঁরই উদ্যোগে ২০০৭ সালে কলকাতার সল্টলেকে সুদূরপ্রসারী “ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন” প্রতিষ্ঠা অসামান্য কাজ। শতবর্ষ পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ এখনো জাগ্রত জাপানে তারই অতিসাম্প্রতিক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ২০২০ সালে উদীয়মান রবীন্দ্রতারকা শ্রীমতী সাসাকি মিকা কর্তৃক নির্মিত অভিনব প্রচেষ্টা “টেগোর সঙস” প্রামাণ্যচিত্রের প্রভূত জনপ্রিয়তা। এটা প্রমাণ করে যে, ভারতের বাইরে জাপানি জাতির মতো রবীন্দ্রসমঝদার আর দ্বিতীয় নেই।
.