কীভাবে মানুষ মরে যায়? কী আশ্চর্যের, কেউ ভাবে না তা নিয়ে!
আর যারা ভাবে, তারা যেন ক্রুসেড বা সালামিস যুদ্ধের ইতিহাস
থেকে স্মরণ করে কিছু একটা।
তথাপি মৃত্যু হলো এমন কিছু যা ঘটে: কীভাবে মানুষ মরে?
এসব না-জেনেও প্রত্যেকেই পেয়ে যায় নিজ নিজ মৃত্যু,
তার মৃত্যু, শুধু তার নিজের, যা বর্তায় না অন্যের ওপর
আর এই মৃত্যু-মৃত্যু খেলার নামই যে জীবন।
গ্রিক কবি জর্জ সেফেরিস-এর এই কাব্যিক উচ্চারণ বস্তুত বলতে চায় মৃত্যুর অনিবার্যতা ও তার উপস্থিতির উদ্ভটতার কথা। সত্যিই, মানুষের মৃত্যুর মতো আশ্চর্যের আর কিছু নেই। প্রতিদিন ঘটছে তা, তবুও তা এক অলীক বাস্তবতা বলে মনে হয়। মহাভারতের ধর্মবকের প্রশ্নেও তাই এই আশ্চর্যতা অন্তর্ভূত, প্রতিনিয়ত এই যে মৃত্যুর খেলা চলে তবু মানুষ তা নিয়ে ভাবে না। বেঁচে থাকতে কত ইহকালিক-পরকালিক প্রজ্জ্বলিত লণ্ঠন ধরিয়ে দেওয়া হয় ব্যক্তির হাতে যেন মৃত্যুর পথ পাড়ি দেওয়া যায় নির্বিঘ্নে, কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তে সবকটি লণ্ঠনই নিভে যায়, অন্ধকারে নেভা লণ্ঠনই সম্বল হয় তার। মৃত্যু নিয়ে যত দর্শন আর সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে, অন্যকিছুতে তেমনটা নয় আর। বুদ্ধদর্শনে জন্ম আর মৃত্যুকে ‘সমগ্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে মৃত্যু হলো জীবনেরই আরেক অধ্যায়ের সূত্রপাত; মৃত্যু হলো মুকুর যেখানে জীবনের সামগ্রিক অর্থময়তা প্রতিফলিত। বুদ্ধের কাছে অস্তিত্ব শরৎকালের মেঘের মতোই ক্ষণস্থায়ী, আর সত্তার জন্মমৃত্যুর অবলোকন নৃত্যের গতিময়তাকে অবলোকনেরই মতো এক ব্যাপার।
মৃত্যু মানসিক ও শারীরিক। মৃত্যুতে মন তাৎক্ষণিক নিশ্চিহ্ন হলেও শরীর পড়ে থাকে, আর প্রয়োজন হয় তার ব্যবস্থাপনার যাকে বলে সৎকার। মৃতদেহ সৎকারের পদ্ধতি মোটাদাগে দুটো: পুড়িয়ে ফেলা আর মৃত্তিকাভূত করা; এর বাইরেও পদ্ধতি আছে, যেমন জরাথুস্ট্রীয়রা মৃতদেহ রেখে দেয় সাইলেন্স টাওয়ারে যেন শকুন বা অন্য শবভূক পাখিরা এসে ভক্ষণ করতে পারে গলিত মাংস। কোনো কোনো গোত্রে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় শব যেন তা সমুদ্রপ্রাণিদের খাদ্য হতে পারে। একসময় আমাদের দেশে শর্পদংশিত অচেতন দেহ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। প্রাচীন মিশরীয়রা মমি করে রাখত বিখ্যাতদের শব। প্রাচীন গ্রিসে দাহ ও কবর, দুটোরই প্রচলন ছিল; ইলিয়াদ-এ দেখা যায়, পাত্রোক্লুস মারা যাওয়ার পর তাকে চিতায় ওঠানো হয়েছিল। অনেকসময় দেহভস্ম ধাতুপাত্রে রেখে তা মাটিতে সমাহিত করা হতো। সাধারণত ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসীদের দাহ করা হয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, আর সেমেটিক ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে কবর দেওয়ার রীতি বহমান যদিও পাশ্চাত্যে দাহপদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছে এখন।
ধর্মীয় বিবেচনার বাইরে শবসংস্কারের মূল উদ্দেশ্য মৃতদেহের জৈব উপাদানগুলোকে অদৃশ্য করে তাদের অনন্তের পথে রওনা করিয়ে দেওয়া। সে যা-ই হোক, মৃতদেহ পোড়ানোর স্নিগ্ধদর্শন হলো পঞ্চভূতে বিলীন করা, যেন কোথাও নেই মৃত কিন্তু রয়েছে সবখানে, এজন্যই দেহভস্ম কখনও-বা ছড়িয়ে দেওয়া হয় নদীতে, পর্বতে, সমুদ্রে। আর কবর দেওয়ারও স্নিগ্ধদর্শন হলো পঞ্চভূতে বিলীন করা, বিশেষত মৃত্তিকা-আধারে স্থিত করা; মনে করা হয় মৃত রয়েছেন এখানে ঘুমিয়ে। প্রথমটির সাথে ইতিহাস-বিস্মৃতি থাকে, অনেক বছর পর আর মনে করাও যায় না বা সম্ভব হয় না যে মৃত ব্যক্তিটির স্মৃতি রয়েছে কোনো স্থানে; কিন্তু দ্বিতীয়, অর্থাৎ কবর ইতিহাসপ্রবণ দারণভাবে। শত শত বছর পরও তা জীবন্ত, পুরোনো কবর যেন প্রত্ন এক স্মৃতিচিহ্নিত মূল্য নিয়ে হাজির হয়; দেখলে আমরা ভাবি, অনেক আগে মারা যাওয়া মানুষটি রয়েছে এখানে, হয়তো একান্তে কথা কয়েও উঠতে পারে! কবরের কাছে গিয়ে আমরা শারীরিকভাবেও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি সে অজানা মানুষের কবর হলেও।
তাই শ্মশানে এপিটাফ মানানসই হয় না যতটা হয় সমাধিতে। কারণ এপিটাফ মানে মৃত ব্যক্তির সম্মানার্থে সমাধিপাথরে লেখা ভাষাখণ্ড, কখনও তা হয় তার নিজের সম্পর্কে যা তিনি যেন বলছেন ওখান থেকে যেখানে তাকে কবর দেওয়া হলো, যেখানে তিনি রয়েছেন। শ্মশানে রয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি নেই যেন। শ্মশান হচ্ছে উপায়, গন্তব্য নয় যেন, কিন্তু কবর দুটোই একসাথে। তবে কখনও কখনও কোথাও কোথাও মৃতদেহ পুড়িয়ে তার ভস্মকে কবর দেওয়া হয় স্মৃতিচিহ্ণিত করার জন্য। যেমন বিখ্যাত কবি টি. এস. এলিঅটকে, মারা যাওয়ার পর, প্রথমে লন্ডনের ‘গোল্ডারস গ্রিন’ শবদাহগারে পোড়ানো হয়, তারপর তাঁর পূর্বপুরুষের গ্রাম ইস্ট কোকারের প্যারিশ চার্চ অব সেন্ট মাইকেল-এ কবর দেওয়া হয়, ফলকে জুড়ে দেওয়া হয় তাঁর বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি:‘ শুরুতে সমাপ্তি মোর, সমাপ্তিতে শুরু: in my beginning is my end, in my end is my beginning।’ রবার্ট মুজিল, বিংশ শতাব্দের বিখ্যাত আধুনিকবাদী অস্ট্রীয় লেখক, ১৯৩৮ সালে যখন অস্ট্রিয়া তৃতীয় রাইখের অংশ হয়ে যায়, তখন তিনি তাঁর ইহুদি স্ত্রী মার্থাকে নিয়ে সুইটজারল্যান্ডে পালিয়ে যান এবং সেখানেই ৬১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর তাঁকে দাহ করা হয়, তাঁর শবের দাহকার্যে মাত্র ৮ জন লোক উপস্থিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী মার্থা তারপর শবভস্ম মন্ট সালেফে অরণ্যে ছিটিয়ে দেন। মৃত্যুর সময় মুজিল কাজ করছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিস-এর তৃতীয় খণ্ডের ওপর।
এপিটাফ হলো মৃত ব্যক্তির স্মরণে সমাধিগাত্রে উৎকীর্ণ শব্দবন্ধ যার থাকে একক সৌন্দর্যময়তা। এছাড়াও, প্রতীকীঅর্থে এর ব্যবহার হয় সংগীতে যা মৃতের সম্মানে পরিবেশন করা হয়, যাকে বলা হয় ‘এপিটাফিয়াম’। এপিটাফ মূলত পাশ্চাত্যরীতির, কবরের ওপর স্থাপিত পাথরে জন্মমৃত্যুর সন-তারিখসহ লিখে দেওয়া হয় এক টুকরো সুনন্দ ভাষ। মৃত ব্যক্তির ভিন্ন এক আত্মপরিচয়কে উপস্থাপন করে তা। অনেক সময় এতে থাকে হেঁয়ালি, থাকে সুন্দর বিরোধাভাস, থাকে মজা, যা তাকে দেয় এক স্মরণীয় উপভোগ্যতা। যেমন, একটি স্মরণীয় এপিটাফ: ‘করো ক্ষমা মোরে, না-জাগার জন্য: pardon me for not rising। আরেকটি এপিটাফ, বিখ্যাত চার্চিলের, যেখানে ফুটেছে আত্মের আর্তি: ‘আমি প্রস্তুত আমার নির্মাতার সাখে সাক্ষাতের জন্য।’ আরেকটিতে রয়েছে লেখা: ‘শুয়ে আছে একজন নাস্তিক, সবকিছু হতাশাক্রান্ত, আর কোনো জায়গা নেই যাবার।’ বিখ্যাত গ্রিক আধুনিক কবি কাজানৎজাকিস-এর এপিটাফটি হলো: ‘কোনো কিছুর আশা করি না আমি, ভীত নই, আমি মুক্ত।’ কাজানৎজাকিস মৃত্যুতে মুক্ত হচ্ছেন, তাঁর কোনো ভয় নেই, কোনো মুখোমুখিতা নেই; মৃত্যুতে সব চুকে গেল বলেই তাঁর বিশ্বাস।
এপিটাফ হতে পারে সুহৃদ বা আত্মীয়দের সৃষ্টও তবে সাধারণত বিখ্যাতদের ক্ষেত্রে তাঁদের বাণী উৎকীর্ণ করে দেওয়াই রেয়াজ। অনেক কবি-লেখখ জীবিতাবস্থায় তাঁদের এপিটাফ রচনা করে যান, এপিটাফ কবিতাও রচনা-আঙ্গিক হিসেবে জনপ্রিয় এক বিষয় কবিদের জন্য। এপিটাফ কবিতা লিখেননি এমন কবি কমই পাওয়া যাবে। জীবিতাবস্থায় রচিত এপিটাফ-কবিতাটিই মৃত্যুর পর জুড়ে দেওয়া হয় সমাধিফলকে, তবে সেরকম কিছু না-থাকলে এপিটাফ-উপযোগী ছোটো কবিতা বা পংক্তিকেও ব্যবহার করা হয় এপিটাফ হিসেবে।
এপিটাফ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে পথিকদের কাছে, তার বাণীর আকস্মিক সৌন্দর্যদ্যুতির জন্য। এপিটাফের ভাষা প্রাণিত ও শানিত, সংক্ষিপ্ত ও নিটোল। যেন অভিব্যক্তিতে অতিকথন বা অপ্রয়োজনীয় সংযোজনকে বলা হয় ‘পুটিং লেগ্স অন আ স্নেক’, মানে অর্থহীনভাবে সাপকে পা জুড়ে দেওয়া; কারণ সাপ বুকে চড়ে, পায়ের প্রয়োজন নেই তার। এপিটাফও বাগ্বাহুল্যকে বাতিল করে। তার উদ্দেশ্য মুহূর্তের উন্মীলন সৃষ্টি করা, একটি স্তম্ভিত মুহূর্তকে উপহার দেওয়া। এপিটাফ যেন পথিকের উদ্দেশ্যেই রচিত, তারা দাঁড়াবে সমাধির কাছে আর পাঠ করবে তা, হয়ে উঠবে সিক্ত, আর অনুভব করবে মৃত ব্যক্তিকে। এপিটাফে ব্যক্তি ঘোষণা করেন নিজের সার্থকতাকে বা ব্যর্থতাকে, এবং তিনি এক্ষেত্রে এক ভিন্ন ও নতুন পরিচয় দিতে চান নিজের। এতদিনকার আত্মপরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান, কখনও বাতিলও করতে চান। উপস্থাপন করতে চান পরিচয়ের এক ঋণাত্মক দ্বন্দ্ব বা ‘নিগেটিভ ডায়লেক্টিকস’, যা প্রতিষ্ঠিত খ্যাতি, সম্মান বা অন্য আত্মপরিচয়কে বাতিল করে এক ঋণাত্মক পরিচয়কে উপহার দিতে চায়। পূর্ণ নয় শূন্য, অস্তিত্ব নয় অনস্তিত্ব, থাকা নয় প্রস্থানজ্জ-এ সংক্রান্ত বিকল্প পরিচয়কে সন্ধান করে তা। কিটস যখন বলেন: ‘here lies one whose name was writ in water: এইখানে শুয়ে আছে একজন যার নাম জল দিয়ে হয়েছিল লেখা’, তখন ফুটে ওঠে এক আত্মপ্রত্যাহারসুর যা হয়ে ওঠে জেনদের মতোই নিজেকে প্রত্যাখ্যানের এক অন্তিমভাষ্য। অস্তিত্বের ক্ষণস্থায়িত্ব এবং মর্মরতার কথা বলেছেন কিটস তাঁর এপিটাফে হয়তো, যার নেপথ্যে ছিল সফলতাহীনতার অভিমান। ইয়েটসের ‘আন্ডার মাউন্ট বেনবুলবেন’ কবিতাটিও, যার শেষাংশ তাঁর এপিটাফ হিসেবে ব্যবহৃত, তুলে ধরে এক নির্মোহতা, জীবন-মৃত্যুর একাকারত্ব এবং যৌথ অসহায়বোধ:
জীবন ও মৃত্যুর ওপর
ফেলো নিরাসক্ত-দৃষ্টি একবার
পাশ দিয়ে যায় চলে ঘোড়সওয়ার!
ইয়েটস-এর কবর পুনঃস্থাপিত হয়েছে মাউন্ট বেনবুলবেন-এর পাদদেশে, এপিটাফ হিসেবে উৎকীর্ণ হয়েছে কবিতাটির শেষাংশ। বস্তুত কবিতাটিতে ভয়াবহভাবে দাঁনা বেঁধে আছে নিরাসক্তি এবং অজানা ও নির্ভারতার দিকে জীবনের প্রবেশগম্যতার কথা। কী চরম অর্থহীনতা! স্বশাসিত অস্তিত্ব চরমভাবে পর্যবসিত ধুলা আর ভস্মের নির্বস্তুকতায়।
অনেক এলিজি লিখেছেন রিলকে, ডুইনো এলেজি, লিখেছেন বিখ্যাত রুশ কবি মারিনা ৎস্ভেতায়েভার উদ্দেশে এলেজি, লিখেছেন রেকুয়েমও। এলেজিকে বর্তমানে মনে করা হয় শোকগাথা যদিও প্রাচীন গ্রিসে এলেজিয়াক দ্বিপদী পদ্যকে এলেজি বলা হতো। রিলকে লিখেছিলেন একটি ছোট্ট কবিতা যা হয়েছিল এপিটাফ তাঁর অতিসাধারণ সমাধিতে, তাঁরই পছন্দের জায়গায়:
গোলাপ, বিশুদ্ধ স্ববিরোধ,
নিদ্রাহীনতার আনন্দ, অসংখ্য
অক্ষিপল্লবের নীচে।
তা মনে করিয়ে দেয় হুইটম্যানের ‘আত্মের গান’ কবিতার পংক্তিকে: ‘তোমার পায়ের জুতার নীচে খোঁজো মোর স্থান।’ রিলকে এ কবিতা লেখেন সেই মৃত্যুরূপী সৌন্দর্যপ্রতীক গোলাপকে নিয়ে যার কাঁটার আঘাতে সূচিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যু-অধিবাস। তারও বহু আগে, একদিন মিউনিকের পার্কে একা একা হাঁটার সময় দেখেছিলেন সেই হাত যা তাঁর চোখের সামনে এসে পড়েছিল, যা তাঁর ‘মৃত্যু’ কবিতায় আধারিত, দেখেছিলেন সেই শুটিং স্টার যা তাঁর চোখে পড়ে অন্তর্গত হয়েছিল শরীরের অভ্যন্তরে।
এপিটাফ আসলে জীবিতের শেষ দান মৃতকে, কবরে যা হয় উৎকীর্ণ। এপিটাফ কবরের শাব্দিক শোভা, আর তা এক বারতা যা জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে, একা ও আহতভাবে। জীবিতরা লিখলেও তা আসলে মৃতের ভাষা, মৃতের অভিলাসিত উচ্চারণজ্জঅস্তিত্ব কথা বলছে যেন অনস্তিত্বের সাথে, বা অনস্তিত্ব কথা বলছে নতুন অস্তিত্বসন্ধানে। এপিটাফই মৃত ও জীবিতের মধ্যকার একমাত্র ও একক ভাষাসন্ধি যা চিরস্তব্ধতার চিহ্নটিকে পৃথিবীর বুকে উঁচিয়ে ধরে রাখে। এপিটাফ বস্তুত কালচিহ্ন যা নির্বাকভাবে কথা চালিয়ে যায় অনন্তের সাথে।
আর প্রায় সব এপিটাফই অতিস্পর্শিক, নাড়া দেয় হৃদয়কে, ক্ষণকালের জন্য হলেও মনে করিয়ে দেয় জীবনের পরিণামকে। এক আকস্মিকের আঘাতে পথচারীর হৃদয় হয়ে পড়ে ব্যথিত। মহাকাল ক্ষণকালে নুয়ে পড়ে যেন আর ক্ষণকাল মহাকালের ইঙ্গিতকে উষ্ণতা দেয়। এবং এপিটাফের কাছে অধিকক্ষণ দাঁড়ানোও যায় না, কাজ করে কাতরতা, ভয় ও অদৃষ্টবোধ। পথচারী কেটে পড়ে অন্যত্র। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সম্ভবত বাঙালির প্রথম এপিটাফ কবিতা লেখক, এজন্যই বলেন: ‘দাঁড়াও পথিকবর, তিষ্ঠ ক্ষণকাল’; তিনি রুদ্ধ করতে চাইছেন না, শুধু কয়েকটি মুহূর্ত, কয়েকটি পলক কাঙ্ক্ষা করছেন পথচারীর কাছে। মাইকেলের এপিটাফ অতৃপ্ত এবং অবচয়িত জীবনের সমাপ্তিপরিচয়কে উন্নমিত করতে চাইছে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে যা শিকড়উন্মোচক: ‘দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন।’
সব এপিটাফই রোপন করে বিহ্বলতার বীজ। সব এপিটাফই জড়সড় করে আমাদের, আস্তিত্বিক অনুবোধে। কিন্তু অনেকসময় তা বক্তব্যের এবং ব্যঞ্জনার কারণে উপভোগ্যও হয়ে ওঠে, যেমন প্রাচীন গ্রিক কবি কাল্লিমাখুস-এর এপিটাফ নামীয় এই কবিতাটি, শিশিরকুমার দাশের অনুবাদে, যা এক চরম সত্যকে আনন্দের উৎসারে, শ্লেষের নির্দোষে উপস্থাপন করছে:
তিমোন আমার নাম, মানুষকে ঘৃণা করি আমি;
পথচারী, মানে মানে সরো এই বেলা
অভিশাপ দিতে চাও, দাও, তাতে কোনো ক্ষোভ নেই
ঘুমের সময় বাপু কোরো না ঝামেলা।
এপিটাফ হলো মৃত্যু-মাদ্রিগাল; নিমগ্ন আর দুরত্বময় কণ্ঠস্বরে যা কাউন্টারপয়েন্ট করে চলে জীবনের, মরণের।
লেখাটি পড়লে বার বার মনে হয়- এমন মানবজনম আর কি হবে…..। এক অতিপরিচিত বিষন্নতায় ছেয়ে যায় চারপাশ। জীবনের অর্থহীন বোধের ভেতরে জেগে ওঠা আরেক তৃষ্ণার সাগর পেরিয়ে মৃত্যু-অমৃতের দিকে এগিয়ে যাবার ধ্বনি শুনা যায় যেন।